জামায়াত ত্যাগে বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে
দলের সব পর্যায়ে নির্বাচিত কমিটি গঠন, জামায়াতে ইসলামীকে জোটে না রাখা, দেশে নির্বাচন ও দল পরিচালনার নিয়ম-কানুন অনুযায়ী কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখা এবং ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ—গুরুত্বপূর্ণ এই চারটি বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকগুলোতে। গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে চলা বৈঠকে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চললেও একমাত্র নারী সদস্য বাড়ানোর বিষয় নিয়ে দলে কাজ শুরু হয়েছে। বাকি তিনটি ইস্যুই অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলোর বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বর্তমানে দল পরিচালনায় কার্যত নেতৃত্বে থাকা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। তবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শ ছাড়া এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে বলেও মনে করছেন দলের নেতারা।
বিশেষ করে ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়ার ওপরই নির্ভর করছে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে তাঁরই উদ্যোগে চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপ লাভ করে। দুই বছর কারাবন্দি থাকাবস্থায়ও ২০ দলীয় জোট ধরে রাখার পক্ষে নির্দেশনা ছিল খালেদার। তবে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ছাড়া স্থায়ী কমিটির সব সদস্যই জামায়াতকে জোটে না রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করায় দলের অভ্যন্তরে জামায়াতকে নিয়ে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দলটির বেশির ভাগ নেতার ধারণা, জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিএনপি ভবিষ্যৎ রাজনীতির কর্মকৌশল প্রণয়নে দলটির নেতাদের মতামত ও পরামর্শের জন্য স্থায়ী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠক চলছে গত ফেব্রুয়ারি থেকে। করোনায় কিছুদিন স্থগিত থাকার পর সম্প্রতি আবার ওই বৈঠক শুরু হয়েছে। গত ১৮ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দীর্ঘ বক্তৃতায় বিএনপির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন। এখন শুধু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতামত দেওয়া বাকি আছে। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তৃতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে তিনি ইচ্ছা করলে এরপরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে আরো সময় লাগবে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি বিএনপির গণভিত্তি যেসব আদর্শের ওপর নির্ভরশীল তার সঙ্গে সমন্বয় করেই আমাদের আগামী দিনে চলার পথ খুঁজে নিতে হবে। তবে স্থায়ী কমিটির নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়ে বক্তব্য দিলেও সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত বিএনপির ক্ষতি নয়, বরং উপকার করেছে। ফলে তাদের জোর করে ঠেলে বের করে দেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই।’ তাঁর মতে, ‘জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত গঠনতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কোনো কথা নেই। তাই যে যত পরামর্শ দিক সেটা পরিবর্তন হবে না।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে অবস্থান নির্ণয়ের পাশাপাশি জামায়াতকে জোটে না রাখার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দুই ঘণ্টারও বেশি বক্তৃতা করেন। তিনি নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বৈশ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান পলিসির কথা তুলে ধরেন। তবে বিএনপিকে ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হলে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে, সে প্রসঙ্গটি সেদিন অনলাইনের মাধ্যমে বৈঠকে যুক্ত থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্মরণ করিয়ে দেন।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ঘোষণাপত্রের ২৯এর (ঘ) তে ‘মুসলিম দুনিয়ার ভ্রাতৃপ্রতিম সকল দেশের সঙ্গে গভীর ও স্থায়ী বন্ধুত্ব অটুট ও সম্প্রসারিত রাখা এবং (ঙ) তে ‘আরব ও ফিলিস্তিন ভাইদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় সমর্থন দানের’ কথা বলা রয়েছে।
বিএনপির ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয় ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে। ওই বছরই ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। দল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধ—এই দুটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্রের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত আছে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ওই বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক বলে দলের অনেক নেতা মনে করেন।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু সেই সৌদি আরবের সঙ্গে এখন ভারত ও ইসরায়েলের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে বিএনপিরই কেউ কেউ পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। ফলে ফরেন পলিসি নির্ণয় করা বিএনপির জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির আহ্বায়ক আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অনেক ইস্যু আলোচনায় এসেছে, কিন্তু এগুলো নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
সূত্র জানায়, দলের সর্বস্তরে কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে বিএনপির ভেতরে বহুদিন ধরেই আলোচনা আছে। সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু জায়গায় কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় দলের মধ্যে নেতিবাচক আলোচনা তৈরি হওয়ায় আমীর খসরু ছাড়াও স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ নেতা সেগুলো উল্লেখ করে সবস্তরে নির্বাচিত কমিটি থাকার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বিষয়গুলো তারেক রহমান কিভাবে গ্রহণ করেন বা করেছেন, সে বিষয়ে বেশির ভাগ নেতার সংশয় রয়েছে। দল পরিচালনার দায়িত্বে খালেদা জিয়া সক্রিয় থাকার সময়েও সর্বস্তরে নির্বাচিত কমিটি গঠনের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।