বাইসাইকেল রফতানির গতি বাড়াচ্ছে কভিড-১৯
বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে বাড়ছে স্বাস্থ্যসচেতনতা। শরীরচর্চা বা স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ থাকার বিষয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এ আগ্রহ বেশি। শরীরচর্চায় মনোযোগের অংশ হিসেবে তাদের চলাচলের বাহনেও এসেছে পরিবর্তন। পশ্চিমা দেশগুলোতে আগে ব্যক্তিগত গাড়ির বহুল ব্যবহার থাকলেও এখন বাইসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বিশেষ করে কভিড-১৯ মহামারীকালে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। সে বাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেড়েছে দ্বিচক্রযানের চাহিদা। কভিডকালে কেবল বাংলাদেশেই বাইসাইকেল রফতানি বেড়েছে ৪২ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা বৃদ্ধিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশের বাইসাইকেলের রফতানি বেড়েছে, তার বেশির ভাগই গেছে ইউরোপের বাজারে। আর অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল জার্মানি।
স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা পূরণে টেকসই বাণিজ্যের জন্য সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন বলে
মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে নগদ সহায়তার ওপর জোর দেন তারা। কারণ পশ্চিমা দেশগুলো বাইসাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধিতে, সড়কে আলাদা লেন বসানোর মাধ্যমে নানা রকমের নীতিসহায়তা দিচ্ছে।
কভিড-১৯ মোকাবেলাজনিত স্বাস্থ্যসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধির মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সচেতনভাবে এসব সহযোগিতা দিচ্ছে সেসব দেশের সরকারগুলো।
বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রফতানি করছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে মেঘনা গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, চট্টগ্রামের সিরাজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে প্রাণ-আরএফএল রফতানি বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের বাজারে প্রাণ-আরএফএলের দুরন্ত ব্র্যান্ডের বাইসাইকেল তৈরি ও বাজারজাত শুরু হয় ২০১৪ সালে। পরের বছরই রফতানি শুরু করে তারা। এ মুহূর্তে বিশ্বের ১০টি দেশে এ কোম্পানির বাইসাইকেল রফতানি হয়। এর মধ্যে প্রধান বাজারগুলো হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও বেলজিয়াম। আন্তর্জাতিক বাজারে যে বাইসাইকেলগুলো যাচ্ছে, তা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়ে রফতানি হয়। এসব পণ্য তৈরি হয় বাজারভিত্তিক। সে হিসেবে লো-এন্ড বাইসাইকেলগুলো দেশের বাজারে বিক্রি হয়। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে যায় উচ্চমানের বা হাই-এন্ড বাইসাইকেলগুলো। যার দামই শুরু হয় ১ লাখ টাকা থেকে।
এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কভিডকালে তাদের সাইকেলের চাহিদা অনেক বেড়েছে। রফতানির ক্রয়াদেশ বা চাহিদা বৃদ্ধিটা অনেক বেশি। অনেক সময় চাহিদা মেটানোও সম্ভব হয় না। তবে এখন তারা সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। সব মিলিয়ে বছরে সাত লাখ পিস বাইসাইকেল তৈরির সক্ষমতার কথা জানালেন তিনি। আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে চাহিদাও বেশ ভালো বলে জানান তিনি। চাহিদা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ার প্রবণতার কথা বলেন এ কর্মকর্তা।
বাইসাইকেল তৈরির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগেও স্থানীয় বাজারে বাইসাইকেলের ব্যবহার ছিল, কিন্তু তা ছিল অনেকটা প্রয়োজননির্ভর। এখন অনেকেই স্বাস্থ্যসচেতনতার অংশ হিসেবে বাইসাইকেলকে কাজে লাগাচ্ছেন। এখন এটা একটা লাইফস্টাইল পণ্য বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে এটা ঠিক, কভিড স্থানীয় বাজারের চাহিদা বৃদ্ধিতে একটা মাত্রা যোগ করেছে। কারণ কভিডকালে গণপরিবহন ব্যবহার স্বস্তিকর নয়, আবার লকডাউনসহ নানা কারণে সবসময় গণপরিবহন পাওয়াও যায় না।
এছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরীরচর্চা কেন্দ্রগুলো বন্ধ। অনেক দেশে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়। ফলে শরীরচর্চার বিকল্প হিসেবে ও যাতায়াতের সুবিধার জন্য এখন মানুষ বেছে নিচ্ছে বাইসাইকেল।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাইসাইকেল রফতানি চাহিদার উল্লম্ফন ফুটে উঠেছে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজারে ৮ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার ডলারের বাইসাইকেল রফতানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ কোটি ডলার।
দেখা যাচ্ছে, চলমান ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই ১২ মাসের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এ নয় মাসে রফতানি হয়েছে ৯ কোটি ৫৬ লাখ ২০ হাজার ডলারের বাইসাইকেল। এ সময়ের কৌশলগত লক্ষ্য ছিল ৭ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের রফতানি। অর্থাৎ নয় মাসের কৌশলগত লক্ষ্যের বিপরীতে রফতানি হয়েছে ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের নয় মাসের তুলনায় এ বছর রফতানি বেড়েছে ৪২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের নয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ৬ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বাইসাইকেল রফতানি করেছিল বাংলাদেশের রফতানিকারকরা।
বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও মেঘনা গ্রুপের ডিরেক্টর অপারেশনস লুত্ফুল বারি বণিক বার্তাকে বলেন, এখন ইউরোপের বাজারেই বাইসাইকেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ইউরোপে আগের চেয়ে বাহন হিসেবে বাইসাইকেলের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সরকারও উৎসাহ দিচ্ছে এসবের ব্যবহার বৃদ্ধিতে। যার প্রতিফলন হিসেবে সড়কগুলোতে বাইসাইকেলের আলাদা লেন দেখা দিচ্ছে। মেঘনা গ্রুপের কারখানায় হাই-এন্ডের বাইসাইকেলগুলোই বেশি তৈরি হয় বলেও জানান তিনি।
সরকারের সহায়তা পেলে বাইসাইকেল খাতটি আরো টেকসই করা সম্ভব উল্লেখ করে লুত্ফুল বারি বলেন, বাজেটে আমরা কিছু নীতিসহায়তা চেয়েছি। যেমন বন্ড ফ্যাসিলিটি পেলে খাতের অনেক উপকার হবে। বন্ড ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি নগদ প্রণোদনাও প্রয়োজন। মোটা দাগে বলতে গেলে পোশাক রফতানিতে যে নীতিসহায়তাগুলো দেয়া আছে, সেগুলো দেয়া হলে বাইসাইকেলেও তৈরি হতে পারে নানা সফলতার গল্প। বাইসাইকেল তৈরিতে অনেক উপকরণ আমদানিও করতে হয়, সেখানেও দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হতে হয় বলে জানালেন তিনি।
জানা গেছে, মেঘনা গ্রুপের সঙ্গে জার্মানির একটি যৌথ অংশীদারিত্বভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক ওই কোম্পানিটির নাম টিউব। মেঘনা কারখানায় তৈরি হওয়া সাইকেলগুলোর দাম ন্যূনতম ১২০ ডলার।