রামপালে সবুজ কমছে বাড়ছে ধূসর এলাকা
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা রামপাল। দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এখানেই। এজন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে আঠারোশ একর জমি। সুন্দরবনের ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার আগেই এখানকার পরিবেশ বিরূপ হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এজন্য এলাকাটিতে গত কয়েক বছরের ব্যাপক মাত্রার শিল্পায়নকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ঘিরে শিল্প-কারখানা আর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরেই জমি ভরাট হয়েছে প্রায় সতেরোশ একর। এছাড়া ফসলি জমি, খাল, পুকুর, জলাশয় ভরাটের কর্মযজ্ঞ এখনো জোরেশোরেই চলছে। ফলে সবুজের আচ্ছাদিত এলাকা থেকে ক্রমেই ধূসর হয়ে উঠছে রামপাল। গুগলের ভূস্থানিক ছবি বিশ্লেষণ করে নেদারল্যান্ডসের ওয়েগেইনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক দেখিয়েছেন, মাত্র সাত বছরের মধ্যে রামপালের প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমি বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ২০১২ সালে যেসব এলাকা ছিল সবুজে আচ্ছাদিত, ২০১৯ সালে সেগুলো পরিণত হয়েছে বালিপূর্ণ ধূসর ভূমিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন সংলগ্ন অন্যান্য এলাকার মতো রামপালও প্রতিবেশগতভাবে বেশ নাজুক। গত কয়েক বছরে এখানে শিল্পায়ন হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে ও ব্যাপক মাত্রায়। এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর আগেই রামপালের পরিবেশ বিরূপ হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, রামপালে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তার ফলে প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে; তা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। ফলে ওই এলাকায় পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তাকে এক অর্থে চিরস্থায়ীই বলা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানালেন, গত কয়েক বছরে এ এলাকার পানির লবণাক্ততা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। বর্তমানে সুপেয় পানির খোঁজ পাওয়াটাই দুষ্কর। এ এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। এক সময় এ এলাকায় কিছু কারখানার দেখা পাওয়া যেত শুধু মোংলা বন্দরের আশপাশে। বর্তমানে বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বাগেরহাটের কাটাখালি পর্যন্ত। আর এসব শিল্প-কারখানা ঘিরে গড়ে উঠছে শপিং মল, ব্যাংকসহ অন্যান্য অবকাঠামো। এক সময় যেসব এলাকায় ধানক্ষেত ছিল, কল-কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় এখন সেসব ধূলিধূসর হয়ে পড়েছে। এ এলাকায় সুপেয় পানি প্রায় পাওয়াই যায় না। পানি সংগ্রহের জন্য বাড়ির মেয়েদের অনেক দূরে যেতে হয়, তাতে নিরাপত্তা সংকটও দেখা দেয়।
স্থানীয়রা বলছেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার আগে অনেক বেশি গাছপালা ছিল। ধানক্ষেত ছিল। সবুজ প্রকৃতি ছিল। সর্বোপরি মানুষের জীবন সহজ ছিল। কিন্তু এখন জায়গাটিতে যান্ত্রিকতা ঢুকে গেছে। মানুষের জীবনযাপনও হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে কঠিন। চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটির জন্য বিপুল পরিমাণ জায়গা অধিগ্রহণ করে নেয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ঘিরে এখন যেসব শিল্প-কারখানা আর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ চলছে, সেগুলোর জন্যও বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের, পুকুর-জলাশয় ভরাট করতে হয়েছে। অন্যদিকে চিংড়ি রফতানি খাতটির জন্য আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসলি জমিকে পুকুর-ঘেরে রূপান্তর করার কাজও চলছে সমানতালে। এসবেরই বিরূপ প্রভাব পড়ছে অঞ্চলটির প্রাণপ্রকৃতিতে।
সুন্দরবন এলাকায় কাজ করেন এমন একজন পরিবেশ কর্মী জানান, উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে এ এলাকার পাঁচ লাখের বেশি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেরই জীবিকা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এক সময় এ এলাকার মানুষের জীবনযাপন সহজ-সরল ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। আগে যারা জমিতে চাষাবাদের কাজ করতেন, পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় তাদের এখন মাছের ঘেরে কাজ করতে হচ্ছে। আবার কয়েক প্রজন্ম ধরে কৃষিকাজ করত এমন পরিবারের মানুষেরা এখন বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, সুন্দরবন এলাকায় গত এক দশকে অপরিকল্পিত ও বেপরোয়া শিল্পায়নের ফলে এ এলাকার পরিবেশ প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আমরা দাবি করে আসছি এ এলাকার পরিবেশগত সমীক্ষা করার জন্য, যাতে বোঝা যায়, যে শিল্পায়ন সুন্দরবন ঘিরে গড়ে উঠেছে, তা সুন্দরবন নিতে পারছে কিনা। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র এক অর্থে ভেঙে পড়েছে। এখানে সুপেয় পানি মিলছেই না। এ এলাকা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া হওয়া সত্ত্বেও এখানে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এক অর্থে অবৈধ। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলকে রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। নীতিনির্ধারকদের এ বনের গুরুত্ব বুঝতে হবে। এ বন রক্ষায় অবিলম্বে লাল তালিকাভুক্ত শিল্পায়ন বন্ধ করা উচিত। বন রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এ বনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাটি মূলত পরিচিত চিংড়ি রফতানির জন্য। অঞ্চলটিতে চিংড়ি উৎপাদন বিস্তার লাভ করতে শুরু করে মূলত গত শতাব্দীর ষাটের দশকের পর থেকে। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় ফসলি জমিতে পুকুর-ঘের করে চিংড়ি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করে এ অঞ্চলের মানুষ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সরকারের কৌশলী নীতিও চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। নব্বইয়ের দশকের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রভাবে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি চিংড়ি উৎপাদনের আওতায় চলে আসে। তবে চলতি শতাব্দীর শুরু থেকেই শিল্পায়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে এ অঞ্চল ঘিরে। শিল্পায়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহজ করতে সরকার একাধিক বড় প্রকল্প গ্রহণ করে অঞ্চলটিতে। রামপালে পরিবর্তন আসতে শুরু করে মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই।
সাবেক বিদ্যুৎ সচিব ও বৃহদায়তনের প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, যেকোনো প্রকল্প শুরুর আগে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যকরণীয়। তবে সুন্দরবন এলাকায় যেসব প্রকল্প হচ্ছে, তার অধিকাংশই কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই নেয়া হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে এসব প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্রও নেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প সে এলাকার জনগণের জন্য দরকার কিনা, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। পরিবেশের ওপর জোর খাটানো চলে না। তার একটা প্রভাব থেকেই যায়। দেশে বনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। সুন্দরবনের আয়তনও কমছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্প সেটিকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে সুন্দরবনের আয়তন কমছে, বিষয়টি এ রকম নয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার বহু আগে থেকে সুন্দরবনে সবুজ জায়গার পরিমাণ কমে আসছিল। সারা পৃথিবীতেই সবুজ জায়গার পরিমাণ কমেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ওই এলাকার মানুষের জীবিকার নতুন সুযোগ তৈরি করায় এখন আর কেউ মাছের ঘেরের ওপর নির্ভরশীল নয়। সুন্দরবন ঘিরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। এক সময় এ এলাকার মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাত। সুন্দরবন ঘিরে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। রামপালসহ আশপাশের এলাকার সুপেয় পানির সংকট মেটাতে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় পুকুর খনন ও উন্নয়নের কাজ চলছে। আগামী বছরের জুন নাগাদ পানি সংকট অনেকখানি কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।