ফিরোজায় নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়া
সরকারের দুই দফায় নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে প্রায় ১০ মাস ধরে গুলশান এভিনিউয়ে ভাড়া বাড়ি ‘ফিরোজা’য় নিঃসঙ্গ দিন কাটছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। এ সময়ে এক দিনের জন্যও তিনি ফিরোজা থেকে বাইরে বের হননি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতির দিকে। করোনাভাইরাসের প্রকোপসহ নানা কারণে নেতা-কর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ মানা। শুধু তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পরিবারের লোকজনই নিয়মিত ফিরোজায় আসা-যাওয়া করছেন। নীরবে-নিভৃতে সময় কাটছে বেগম জিয়ার। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসসহ নানা কারণে এখনো করোনাভাইরাসের টিকা নেননি খালেদা
জিয়া। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসার পাশাপাশি শারীরিকভাবে সুস্থবোধ করলে পরে সুবিধাজনক সময়ে তিনি টিকা নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ফাইজারের টিকা নিতে পারেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
দলীয় ও পারিবারিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা জেলবন্দী সময়ের চেয়ে এখন অনেক উন্নতির দিকে। তাঁর খাওয়াতেও এখন কিছুটা রুচি বেড়েছে। তবে তাঁর আর্থাইটিস, ডায়াবেটিসসহ অন্যসব রোগ এখনো বিদ্যমান। ডায়াবেটিসও ওঠানামা করে। নিয়মিতই তিনি ডায়াবেটিসসহ উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন করছেন। এখনো তাঁর চলাফেরায় কারও সাহায্য নিতে হয়। জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথাও আছে। বাসায় দুজন নার্স স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে। তারা বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন এবং ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন। বাম চোখেও একটু সমস্যা রয়েছে তাঁর। বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রতিনিধি দলের একাধিক সদস্য জানান, প্রতিদিনই একজন চিকিৎসক ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও যান মাঝেমধ্যে। ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তিনি। এখন নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা ৮ থেকে ১৪-এর মধ্যে ওঠানামা করে। লন্ডন থেকে পুত্রবধূ, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান বেগম জিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন।
এ নিয়ে কথা হয় বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের সিনিয়র সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি গতকাল রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। ম্যাডামের স্থায়ী চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়া জরুরি। এখনো ডায়াবেটিস ওঠানামা করে। আগে জয়েন্টে জয়েন্টে যে ব্যথা ছিল সেগুলো এখনো আছে। এখনো তিনি আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। কাউকে ধরে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। ম্যাডামের চিকিৎসা সার্বিকভাবে তদারকি করছেন তার পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান। আমরাও সহযোগিতা করছি।’
জানা যায়, নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়ার এখন অবসরের সঙ্গী পত্র-পত্রিকা আর বই পড়া। দীর্ঘ সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন। মূলধারার সব পত্রিকাই তাঁর বাসভবনে বান্ডিল করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বেসরকারি টেলিভিশনের খবরাখবরও দেখে সময় কাটান তিনি। এ ছাড়া লন্ডনে থাকা বড় ছেলে তারেক রহমান, তার দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলেও সময় কাটে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বড় ভাই মরহুম সাইদ এস্কান্দারের পরিবার, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের পরিবার, সেজো বোন সেলিনা ইসলাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও বাসায় কথাবার্তা বলে সময় কাটে বেগম জিয়ার।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সেজো বোন সেলিনা ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে খালেদা জিয়ার এখন উন্নত চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। বাসায় থেকেই যতটুটু সম্ভব চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর শরীরের গিরায় গিরায় এখনো ব্যথা কমেনি। নিজে একা দাঁড়াতেও পারছেন না, হাঁটাচলাও করতে পারছেন না। কাউকে ধরে নিয়ে যেতে হয়। বিছানা থেকে বাথরুমে যেতেও কারও সাপোর্ট প্রয়োজন। খাবারে কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিক খাবারই খাচ্ছেন। যখন যেটা তাঁর পছন্দ সেটাই রান্না করে দেওয়া হয়।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান তারেক রহমান। কিন্তু সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগার থেকে বেগম জিয়া বের হওয়ার পরও তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, সাময়িক মুক্তি পেলেও আইনগতভাবে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না। তাই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল পরিচালনা করছেন। বেগম জিয়ার ওপর থেকে আইনি জটিলতা কেটে গেলে তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। দেশবাসী সেই আশা নিয়েই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, নানা বিধিনিষেধের কারণে বেগম জিয়া রাজনৈতিক কোনো কথাবার্তা বলছেন না। তারেক রহমানকেই দল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ নিয়ে তারেক রহমান দল পরিচালনা করছেন। এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছুদিন আগেও খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। বর্তমানে সেই প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে বলে জানা যায়। অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য সরকার ও পরিবারের আলোচনার মাধ্যমে বেগম জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কূটনৈতিক মহলও এ নিয়ে উদ্যোগী হয়। সরকার অনুমতি দিলে ব্রিটিশ হাইকমিশন বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য ভিসা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে নতুনভাবে সরকারের কাছে আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় কারাজীবন শুরু করেন খালেদা জিয়া। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তাঁর সাজার রায় হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আরও ৩৪টি মামলা রয়েছে। গতকাল একটি মামলায় নড়াইলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। ২৫ মাসেরও বেশি সময় কারাবন্দী থাকার পর বিদায়ী বছরের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া করোনাকালে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। এরপর আরও এক দফায় তাঁর জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। জামিনে মুক্তির পর থেকে তিনি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ রয়েছেন।