ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
আপডেট : ৩০ জানুয়ারী, ২০২১ ১৯:২১

ইউএস-বাংলা এখন আতঙ্কের বাহন

অনলাইন ডেস্ক
ইউএস-বাংলা এখন আতঙ্কের বাহন

ফ্লাইট ছাড়ার আগে দেখা গেল ফ্লাইটের ওয়েদার রাডার কাজ করছে না। ঠিক করার জন্য বলা হলো তখন অফিস থেকে হচ্ছে হবে করা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর কর্তৃপক্ষের একজন ফোন করে বলছেন, স্পেয়ার নেই বা এটা এখন ঠিক করতে গেলে ফ্লাইটের টাইম এলোমেলো হয়ে যাবে। এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। এভাবেই বাধ্য করে ফ্লাইট চালানো পাইলট যাত্রী সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। কথাগুলো বলছিলেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একজন পাইলট। মাত্রাতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের এভাবে পাইলটদের চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ অনেক পুরনো। নেপালের কাঠমান্ডুতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৫১ জনের প্রাণহানির ক্ষেত্রেও সেই ফ্লাইটের আগে পাইলট আবিদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টির অভিযোগ আছে ইউএস-বাংলা এয়ালাইনসের ওপর।

ইউএস-বাংলার এয়ারলাইনসে কক্সবাজার যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাওয়া চিকিৎসক ডা. আদিবা মাহবুবা বলেন, এরা বিমানের ক্রটি নিয়ে জোর করে যাত্রী নিয়ে রওনা হয়, তার পর ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করায়। এটা প্রথমবার নয় এর আগেও বহুবার এরকম হয়ে গেছে। এদের কাছে মানুুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। একটা প্লেনের ল্যান্ডিং গিয়ার ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই কীভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব। জানা যায়, সম্প্রতি ইউএস-বাংলার মালয়েশিয়াগামী একটি ফ্লাইট যাত্রাপথে কারিগরি ত্রুটি দেখতে পেয়ে ঢাকায় ফিরে এসে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণে বাধ্য হয়। এর আগে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর পরই ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যা বুঝতে পেরে শাহ আমানত (রহ.) বিমানবন্দরেই জরুরি অবতরণ করে ইউএস-বাংলার আরেক ফ্লাইট। এ ছাড়া নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পর রানওয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজের পেছনের চাকা ছিটকে যায়। উড়োজাহাজটি নির্ধারিত জায়গা থেকে আরও সামনে অবতরণ করে। রানওয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে এটি থামে। এর আগে ২০১৮ সালের মার্চে ঘটে বাংলাদেশের এভিয়েশনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গত ১২ মার্চ নেপালে ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়। কাঠমান্ডুর এভিয়েশনের দাবি, পাইলটও ছিলেন মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে এবং সেই এয়ারক্রাফটের কারিগরি সক্ষমতার অভাব ছিল।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও ইউএস-বাংলার সাবেক পাইলট ওয়াহিদ-উন-নবী বলেন, ‘পাইলটের দক্ষতায় একবার দুবার করে তিনবার হয়তো বেঁচে গেলাম। কিন্তু চারবারের বেলায়ও যে বেঁচে যাব তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে। আর যাত্রী নিয়ে আকাশে ওড়া বিমান নিশ্চয়ই কারও কোনো টেস্টিং গ্রাউন্ড হতে পারে না। তিনি বলেন, হ্যাঁ এটা সত্য পাইলটরা পেশাদার, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেন। কিন্তু এয়ারক্রাফটের কারিগরি সক্ষমতার দিকগুলো মেনে না চললে এভিয়েশন খাত ধ্বংস হয়ে যাবে এটা সবারই মনে রাখা ও মেনে চলা উচিত। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের মতে, কারগরি ত্রুটি হতে পারে, কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইনসগুলোর বিরুদ্ধে লাভের জন্য কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে, এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সিভিল এভিয়েশনকে। যথাযথ নিয়ম রক্ষা না হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিভিল এভিয়েশনকে এয়ারলাইনসগুলোর জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা গেলেও বাংলাদেশে তা হয় না। জানা যায়, পরপর একাধিক দুর্ঘটনায় পড়া বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস বাংলার বহরে থাকা বিমানগুলোর কারিগরি মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এয়ারক্রাফটগুলোর বয়স, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ সঠিক প্রক্রিয়ায় হয় কিনা, এগুলো চলাচলের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকেও একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফায় চিঠি দিয়ে, বহরের প্রতিটি বিমানের কারিগরি মান ও পরিস্থতি জানাতে বলা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সব থেকেই কোনো ত্রুটিহীন প্রতিবেদন জমা পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ারক্রাফটের কারিগরি সক্ষমতার দিক দেখার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। তারা এর দায় এড়াতে পারে না। এখন যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে বহরে থাকা বিমানগুলো বাধ্যতামূলক সি-চেক বা পর্যালোচনা করতে হবে এবং ত্রুটি পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিতে হবে সেই এয়ারক্রাফটের পরিষেবা।

অন্যদিকে, শুধু এয়ারক্রাফটের ত্রুটি বিচ্যুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ফ্লাইট পরিচালনার শুরু থেকেই গ্রাহক হয়রানির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এয়ারলাইনস সংস্থাটি। ইউএস-বাংলা, তাদের ফ্লাইটসমূহে সোনা চোরাচালান ও মাদক চালান বহনেরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ইদানীং ইয়াবা বহনকারী মাদকচক্রও নিরাপদ বাহন হিসেবে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটগুলো অবাধে ব্যবহার করছে বলেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিএস ১৪৬ যোগে ঢাকায় আসা যাত্রী শাকিল মিয়ার কাছ থেকে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ২ হাজার ২৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এই ইয়াবার বাজার মূল্য সাড়ে ১১ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফের জনৈক আবিরের কাছ থেকে সে এই ইয়াবা সংগ্রহ করে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছাতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট ব্যবহার করে থাকে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা থাকায় মাদকের বড় চালানগুলো বিমানে যাত্রীবেশে আনার ঘটনা ঘটে চলছে। এক্ষেত্রে ফ্লাইটের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকারও অভিযোগ উঠেছে।

পদে পদে গ্রাহক হয়রানির যেন শেষ নেই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের। গন্তব্যে যাত্রী পৌঁছাতে না পেরে অন্য বিমানে যাত্রী তুলে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটানো হয়। তাছাড়া মাঝ আকাশ থেকেই যাত্রীসমেত ফ্লাইট ফিরিয়ে আনা, এক স্থানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে অন্য গন্তব্যে পৌঁছানো, এসি বিকল থাকায় হাত পাখার বাতাস নিতে নিতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট ভ্রমণের হাস্যকর নানা কাহিনি এখন যাত্রীদের মুখে মুখে ঘুরেফিরে। এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্ট একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে সরকারি এয়ারলাইনসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে সময় ঠিক রাখার জন্য আগ্রাসীভাবে ফ্লাইট চালাচ্ছে তারা। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ থেকেও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ফ্লাইট পরিচালনা। কুয়াশার মধ্যে বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট বন্ধ রাখলেও কোনো কোনো বেসরকারি এয়ারলাইনস তার মধ্যেই ফ্লাইট চালিয়েছে।

উপরে