এম এ হাসেম শূন্য থেকে শিখরে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বসের তালিকায় বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন তিনি। শূন্যে দাঁড়িয়ে পারটেক্স গ্রুপকে দেশের অন্যতম বৃহৎ কম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সেই উদ্যোক্তার নামই এম এ হাসেম। পারটেক্স গ্রুপের মাধ্যমে এই মেধাবীই নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যানুফ্যাকচারিং, সার্ভিস, ট্রেডিংসহ বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানে। দেশে তিনিই প্রথম কনডেন্সড মিল্ক কারখানার জনক। সেই কনডেন্সড মিল্কের নাম ‘ড্যানিশ’। এমন অসংখ্য আমদানি বিকল্প পণ্য দেশে তৈরি করে দেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেন বহুমাত্রিক এই ব্যবসায়ী। এমনকি যে বোতলজাত পানির নাম সবার মুখে মুখে সেই ‘মাম’ পানির কারিগরও পারটেক্স।
সেই পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম (৭৭) গত বুধবার রাত ১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সুলতানা হাসেম, পাঁচ ছেলে আজিজ আল কায়সার, আজিজ আল মাহমুদ, আজিজ আল মাসুদ, রুবেল আজিজ ও শওকত আজিজ রাসেলসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় করপোরেটজগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত তাঁর সব বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী স্মৃতিচারণাসহ সমবেদনা জানাচ্ছেন।
জানা যায়, পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ব্যবসার উত্থান ও সফলতা শুরু হয় চট্টগ্রামের ‘মেসার্স হাসেম করপোরেশন’ দিয়ে। ১৯৭০ সালের শুরুতে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে তিনি আমদানি-রপ্তানি-ট্রেডিং ব্যবসা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ধীরে ধীরে সফল হওয়ার পরই তিনি ঢাকায় পাড়ি জমান; গড়ে তোলেন পারটেক্স গ্রুপ। এখনো সেই ঐতিহ্যবাহী এবং স্মৃতিঘেরা কার্যালয়টি দিয়েই চট্টগ্রামের ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। খাতুনগঞ্জে সেই কার্যালয়ের পাশেই আছে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর ব্যবসার সবচেয়ে বড় এবং অনুকরণীয় দিক হচ্ছে ‘কমিটমেন্ট’। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ব্যবসা যেহেতু করতেন, তাই হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে কিন্তু যেই দামে বিক্রির কমিটমেন্ট ছিল, সেই দামেই তিনি পণ্যটি ক্রেতাকে দিয়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেটি ধরে রেখেছেন।
এম এ হাসেম ব্যবসা এবং শিল্পায়নের জগতে এক তুলনাহীন ঐতিহ্য রেখে গেছেন। তিনি পারটেক্সের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং করপোরেট কালচারের এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন, যা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে আজও বিদ্যমান।
এম এ হাসেম ১৯৪৩ সালের ৩০ আগস্ট নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তামাকের ব্যবসার মাধ্যমে তাঁর ব্যবসায়ীজীবনের সূচনা হয়। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মেসার্স হাসেম করপোরেশন (প্রা.) লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গুণগত মান এবং সেবার প্রতি আপসহীন মনোভাবের কারণে এই গ্রুপ এখন এক নতুন উচ্চতায়।
সদ্যঃস্বাধীন দেশে যখন প্রায় সব কিছুরই স্বল্পতা ছিল, ঠিক তখন তিনি লোহা, ইস্পাত, সিমেন্ট, চিনি, চাল, মসলা, গম, লবণ, দুধ এবং অন্যান্য নিত্যপণ্য আমদানিতে আত্মনিয়োগ করেন। এখানেই থেমে না থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে আমদানি করা পণ্য দেশে তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণেই জন্ম হয় পারটেক্স গ্রুপের। বছরের পর বছর ধরে উৎপাদন ও পরিষেবা বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন—ফার্নিচার, বোর্ড, খাদ্য ও পানীয়, প্লাস্টিক, কাগজ, তুলা, সুতা, পাট, রিয়েল এস্টেট, টেক্সটাইল, শিপিং, অ্যাগ্রো, গার্মেন্টস, এরোমেরিন লজিস্টিকস ইত্যাদি আলোর মুখ দেখে।
এম এ হাসেম দেশের বেসরকারি ব্যাংক এবং বীমা সংস্থার প্রতিষ্ঠা ও সেগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনতা ইনস্যুরেন্স।
এম এ হাসেম সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০১ সালে তিনি তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা নোয়াখালী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন তিনি।
এসবের বাইরেও এম এ হাসেম একজন সমাজসেবক ছিলেন। নিজ শহর নোয়াখালীতে তিনি নিজের নামে একটি স্কুল এবং একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যে দুটিই অলাভজনক সংস্থা। তিনি নোয়াখালীর এম এ হাসেম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।