বেসামাল পরিস্থিতি কাটেনি হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তি। মান বাড়ানোর তাগিদ সংসদীয় কমিটির
তিন মাস আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন নাজমা বেগম। ফলোআপ চিকিৎসা চলছে তার। প্রতি মাসে চিকিৎসক দেখাতে হয় তার। তার ছেলে ইব্রাহিম হোসেন বলেন, প্রতি মাসে মাকে রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসক দেখাতে হয়। করোনা সনদ ছাড়া রোগী দেখেন না চিকিৎসক। কোনো ধরনের উপসর্গ না থাকলে প্রতি মাসে মায়ের করোনা টেস্ট করাতে হয়। শুধু এই রোগী নয়, চিকিৎসা নিতে এসে এমন ভোগান্তিতে পড়ছেন অন্যান্য সাধারণ রোগীরা। করোনা টেস্ট সনদ ছাড়া রোগী দেখছেন না চিকিৎসকরা। সরকারি হাসপাতালে জরুরি রোগী নিয়ে গেলে ভর্তির আগে তার করোনা নেগেটিভ সনদ চাওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি করে করোনা টেস্ট না করিয়ে জরুরি রোগীকে নিয়ে গিয়ে আগে করোনা টেস্ট করাতে বলা হচ্ছে। এখনো করোনা পরিস্থিতিতে বেসামাল হাসপাতালগুলো। দুই মাস ধরে কাশিতে ভুগছিলেন জামালপুরের সালেহা বেগম (৮৩)। এর সঙ্গে রয়েছে উচ্চরক্তচাপ, বাতের ব্যথাসহ বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগ। কাশির কারণে জামালপুর থেকে ডাক্তার দেখাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আসেন তিনি। তার করোনার উপসর্গ না থাকলেও কর্তৃপক্ষ করোনা টেস্ট করালে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। পরিবারের সন্দেহ হওয়ায় পরের দিন আবার টেস্ট করালে তার করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয় ওই হাসপাতাল থেকেই। সালেহা বেগমের ছেলে শাহজাহান আলী বলেন, আমার মা যে চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা করান তিনি এই হাসপাতালে কর্মরত। দুই মাস ধরে মা কাশিতে ভুগছেন, এর সঙ্গে বাতের ব্যথাও বেড়েছে। তাই জামালপুর থেকে মাকে নিয়ে এসে রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছাই। মাকে জরুরি বিভাগে রাখা হয় করোনা টেস্ট করার জন্য, সেখানে করোনা রোগীও ছিলেন। রাত ১২টায় টেস্টের নমুনা নেওয়া হয়। পরের দিন দুপুরে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়। দুই মাস কাশি থাকলে তো আর করোনার উপসর্গ হয় না। আমাদের সন্দেহ হওয়ায় ওই হাসপাতালে আবার নমুনা দিই। পরের দিন রিপোর্ট আসে করোনা নেগেটিভ। আমার ৮৩ বছর বয়সী মাকে ভুল রিপোর্ট দিয়ে করোনা রোগীদের সঙ্গে রেখে তার জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শীত আসতেই করোনা হাসপাতালে আবারও রোগীদের ভিড় বাড়ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি মৃত্যুর হারও ঊর্ধ্বমুখী। এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো। সরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো হাসপাতালেই ফাঁকা নেই আইসিইউ। সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্ধ হওয়া অস্থায়ী করোনা হাসপাতালগুলো আবারও চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা বাড়াতে সরকার চেষ্টা করছে। এদিকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর পাশাপাশি অন্য রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। হাঁচি, সর্দি-কাশিসহ শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বর দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা ছিল ১৩ হাজার ৬১৮টি। হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ৮১৯ জন। ফাঁকা ছিল ১০ হাজার ৭৭৯টি শয্যা। করোনা রোগীদের নির্ধারিত আইসিইউ ছিল ৫৩২টি, ফাঁকা ছিল ২৩৪টি। ২ ডিসেম্বর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ১৬৯টি শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ছিল ৭৬টি। ১৬টি আইসিইউয়ের মধ্যে ফাঁকা ছিল চারটি। কুর্মিটোলা হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি আইসিইউর মধ্যে তিনটি ফাঁকা ছিল। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে চারটি ফাঁকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কোনো আইসিইউ ফাঁকা নেই। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ছয়টি ফাঁকা ছিল। গতকাল কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। সাধারণ শয্যা ফাঁকা থাকলেও সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক ডা. মুখলেসুজ্জামান হিরো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প কিছু নেই। যেহেতু এখনো আমরা ভ্যাকসিন বা টিকা পাইনি, তাই মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট থাকলে সেখানে দ্রুত আইসিইউ বাড়াতে হবে। বন্ধ হওয়া করোনা হাসপাতালগুলো আবারও চালু করতে হবে। করোনা শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই যেমন সচেতন ছিলেন, এখনো সেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।’
হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর সুপারিশ : করোনাকালে হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এ ছাড়া করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অধিকতর সচেতনতার জন্য জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারণা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। সংসদ ভবনে গতকাল সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ। কমিটির সদস্য মো. দবিরুল ইসলাম, মো. ফখরুল ইমাম ও আরমা দত্ত বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। সংসদের গণসংযোগ বিভাগ জানায়, বৈঠকে কমিটির পঞ্চম বৈঠকের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি, জাতীয় সংসদের ফ্লোরে প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের হালনাগাদ অবস্থা এবং সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। কমিটি প্রতিশ্রুতিগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে যথা সময়ে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করে। বৈঠকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর, আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বিভিন্ন সংস্থার প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।