সাভারে গড়ে উঠছে আরেক ঘিঞ্জি শহর
ছোট ছোট বাড়িঘর, কৃষিজমি, উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়, নানা প্রজাতির গাছ- এই ছিল একসময়ের সাভার। এখন বহুতল ভবনের সঙ্গে বেড়েছে ঘিঞ্জি বাড়ি, সরু রাস্তা, কল-কারখানা। বেড়েছে মানুষের বসতি। নগর গবেষকরা বলছেন, নব্বইয়ের দশক থেকে সাভারের চিত্র বদলাতে শুরু করে। একের পর এক গড়ে ওঠে ছোট-বড় কল-কারখানা। কারখানাগুলোতে কাজ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে থাকে মানুষ। তাদের বসবাসসহ নানা চাহিদাকে কেন্দ্র করে সাভারে বাড়তে থাকে ভবনের সংখ্যা। এতে সাভারের অর্থনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। নগরবিদদের মতে, রাজধানী শহরের পাশে আরেকটি শহর গড়ে উঠছে খুবই অপরিকল্পিতভাবে। একসময়ের উন্মুক্ত সাভারে এখন খেলার মাঠের অভাব। দ্রুত কমছে কৃষিজমি ও জলাশয়। পৌর এলাকায় নেই পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত নালা। নেই পয়ঃবর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা। পৌরসভা থেকে পানি সরবরাহ করা হয় না। গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও আছে বিশৃঙ্খলা।
ঢাকার গাবতলী পার হলেই শুরু হয় সাভার এলাকা। সেখান থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে মাত্র ১৪ কিলোমিটার গেলেই সাভার বাসস্ট্যান্ড। বাস থেকে নামতেই চোখে পড়ল ফুটপাথবিহীন রাস্তার এক পাশ ধরে টিফিনের বাটি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন সারিবদ্ধ নারী-পুরুষ। রাস্তার পাশের দোকানিরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশারচালকরা অপেক্ষা করছেন যাত্রীর জন্য। বাস থেকে আসছে নবীনগর, ধামরাই যাওয়ার হাঁকডাক। বাসস্ট্যান্ডের একটি দোকানে কথা হয় পৌর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ খলিলুর রহমানের সঙ্গে। বয়স তার ৭০ ছুঁই ছুঁই। আগে কৃষিকাজ করতেন, এখন ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ‘সাভার আর আগের মতো নেই। বেশির ভাগ বাড়িঘর দোতলা। একসময় মানুষ কম ছিল। এখন বাইরের মানুষই বেশি। বেশির ভাগই কারখানায় কাজ করে। স্থানীয় লোকজনও ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। খেতে কাজ করার জন্যও মানুষ পাওয়া যায় না।’ বাসস্ট্যান্ডের কিছু দূরে পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন, ব্যাংক কলোনি, দক্ষিণ দরিয়াপুর ও থানা রোড। এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেল, ভবনগুলো ছয় তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত উঁচু। ভবনগুলো উঁচু হলেও থানা রোড ছাড়া অন্য এলাকার রাস্তাগুলো সরু। ভবনগুলো প্রায় লাগোয়া। পৌর এলাকার কোথাও কোনো পার্ক নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ছাড়া খেলাধুলার জন্য কোনো মাঠও চোখে পড়েনি। পৌর এলাকার বাইরে ইসলামনগর, আশুলিয়া, জিরাব, কাউন্দিয়া, বিরুলিয়া, আমিনবাজার, হেমায়েতপুর ঘুরেও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ছাপ দেখা গেছে। বদলে যাওয়া সাভার সম্পর্কে জানতে রাজউক, সাভার উপজেলা, সাভার পৌরসভা ও সাভারে দুটি ইউনিয়নের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আয়তন ২৮০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে আছে দুটি থানা, একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন। এ উপজেলার প্রায় পুরো অংশই রাজউকের আওতায়। সাভার নিয়ে ২০০৬ সালে একটি জরিপ করেছিল রাজউক। ওই জরিপ অনুযায়ী ২০০৬ সালে সাভারে মোট অবকাঠামো ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ১০টি। ওই সময় মূল ঢাকা শহরে (সিটি করপোরেশন এলাকা) অবকাঠামো ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ২৩২টি। আর ২০১৬ সালের জরিপে দেখা গেছে, সাভারে মোট অবকাঠামো হয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৫৩টি আর মূল ঢাকা শহরে ৩ লাখ ২২ হাজার ৩৬৩টি।
ভবন নির্মাণের অনুমোদনে বিশৃঙ্খলা : কাগজে-কলমে সাভার এলাকা রাজউকের অন্তর্ভুক্ত হলেও এখানে সংস্থাটির তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ভবন নির্মাণে কেউ অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে নেন, না হলে নেন না। এসব কাজে নেই শৃঙ্খলা ও নজরদারি। জানা গেছে, পৌর এলাকায় ভবন তৈরির অনুমোদন দেয় পৌরসভা। আর পৌর এলাকার বাইরের ভবন তৈরির অনুমোদন দেয় উপজেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ। তাই সাভারে এখন অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত, কোন শ্রেণির ভবন কতটি আছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কারও কাছে নেই। ১৪ দশমিক শূন্য ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে সাভার পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯২ সালে। প্রতিষ্ঠার ১১ বছর পর ২০০৩ ও ২০০৪ অর্থবছর থেকে পৌর এলাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া শুরু করে সাভার পৌরসভা। ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার ২৪৬টি ভবনের অনুমোদন দিয়েছে এ সংস্থা, যার মধ্যে বহুতল তৈরি পোশাকের কারখানাও রয়েছে। সাভার পৌরসভা সূত্র জানায়, ভবনের অনুমোদন দিলেও নির্মাণের সময় কোনো তদারকি থাকে না পৌরসভার। সাভারের অন্যান্য এলাকায় ভবন নির্মাণ সম্পর্কে সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা আরা নিপা জানান, আগে উপজেলা পরিষদ থেকে অনুমোদন দেওয়া হতো। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধসের পর সেটি বন্ধ আছে। এখন রাজউক থেকেই অনুমোদন নিতে হয়। তবে অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে সাভার ওয়াপদা রোডে একটি ছয়তলা ভবন হেলে পড়ে। এই ভবন নির্মাণের কোনো অনুমোদন ছিল না। ছয় মাস আগে হেমায়েতপুরে পাঁচতলা একটি ভবন হেলে পড়ে। ২০০৩ সালে নির্মাণ করা ওই ভবনের কোনো অনুমোদন ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ ভবনই পাকা। দুই-তিনতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত ভবনও আছে। এই ইউনিয়নের সচিব মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব ভবনের অনুমোদন তারাই দিয়েছেন। গত দুই-আড়াই বছরে এ এলাকায় রাজউকের কাউকে তিনি আসতে দেখেননি। এ ব্যাপারে জানতে রাজউক চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির তথ্য কর্মকর্তা শাহ আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাভারের পুরো এলাকাই রাজউকের অন্তর্ভুক্ত। তাই কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে। পৌরসভার অনুমোদন দেওয়া পুরোপুরি অবৈধ, ইউনিয়ন তো আরও পারে না। তিনি বলেন, অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের অনুমোদন না দিতে সাভার পৌরসভাকে একাধিকবার বলা হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। এটি চলতে থাকলে সাভারের অবস্থা পুরান ঢাকার চেয়ে খারাপ হবে এবং শহর অচল হয়ে যাবে বলে তার আশঙ্কা।
বছরে কমছে ৮৫৪ একর কৃষিজমি : সাভার পৌরসভার পাশের এলাকা ইসলামপুর গ্রাম। তবে একে গ্রাম বলা হয়তো ঠিক হবে না। এখানে এত বহুতল ভবন হয়েছে যে গুনতে গেলে মাথা ধরে যায়। এ এলাকার বাসিন্দা ইমদাদুল হক বলেন, ১০-১২ বছর আগেও এখানে তেমন বাড়িঘর ছিল না। বেশির ভাগ জমিতে ধান চাষ হতো। এখন এখানে ৮-১০ তলা পর্যন্ত ভবন হয়েছে। ফলে কৃষিজমি কমে গেছে।
ভরাট হচ্ছে জলাশয় : সাভার পৌর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহেদ বলেন, সাভার নিউমার্কেটের পেছনের এলাকাটি শাহীবাগ। ১০-১৫ বছর আগেও এ এলাকা ছিল ডোবার মতো। এখন সেখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। নির্মাণ করা হয়েছে শতাধিক বহুতল ভবন। ভরাটের এ হার তুলনামূলকভাবে বেশি সাভারের তুরাগ নদের অংশ ও আশুলিয়া এলাকায়। রাজউকের এক জরিপ বলছে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তুরাগের আশপাশে ৬০০ একরের বেশি জায়গা ভরাট করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০?১০ সালে সাভার এলাকায় ২০ হাজার ৬৩৮ একর জলাশয় চিহ্নিত করা হয়েছিল। চলতি বছরের শুরুতে দেখা গেছে, চিহ্নিত জলাশয়ের মধ্যে ৩ হাজার ৬৫ একর ভরাট হয়ে গেছে। সাভারের আশুলিয়া, কাউন্দিয়া ও বিরুলিয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নাঞ্চলগুলোতে এখন পানি। কিন্তু পানির মাঝখানে ছোট ছোট টিলার মতো এলাকা। এগুলো ভরাট করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাভারে রাজউকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নগরায়ণের ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা মানা হয় না। আবাসিক এলাকায় শিল্প-কারখানা হচ্ছে, চোখের সামনে নিম্নাঞ্চল ভরাট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাভারের অবস্থা একসময় ঢাকা শহরের চেয়েও খারাপ হবে। তিনি বলেন, সাভার এলাকার নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজউকের না পৌরসভার, তা ঠিক করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক নগরায়ণ করতে হবে।