ঢাকা, বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪
আপডেট : ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ১৪:১৫

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বর্ণাঢ্য এক জীবন

অনলাইন ডেস্ক
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বর্ণাঢ্য এক জীবন

খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক চলে গেলেন শনিবার সকালে। তার অনন্য কীর্তি স্মরণ করছে দেশ। বর্ণাঢ্য এক জীবনে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নিজের মেধা ও সততার স্বাক্ষর রেখে গেলেন।

রফিক-উল হকে জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। বাবা মুমিন-উল হক পেশায় ছিলেন চিকিৎসক, চব্বিশ পরগনায় মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার মা নূরজাহান বেগম।   তার বাল্যকাল কেটেছে কলকাতায়। পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় চেতলা স্কুলে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৫৮ সালে এলএলবি করেন।

শিক্ষা জীবন ও রাজনীতি প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় একবার বলেছিলেন, “আমার কলেজ লাইফ হচ্ছে ইসলামিয়া কলেজ। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতাম বেকার হোস্টেলে। ওখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন। আমি যে রুমটাতে ছিলাম, তার পাশের দুটো রুমেই বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম হয়েছে। আপনারা শুনেছেন, আমি গিয়েছিলাম উদ্বোধন করতে। ২৬ ও ২৭ নম্বর রুম এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। আমি পাশের ২৪ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার ভাইয়েরাও ওখানে থেকেছে, আমিও ওখানে থেকেছি। তারপর ইউনিভার্সিটি-জীবনে কারমাইকেল হোস্টেলে থেকেছি। ওখানেও শেখ সাহেব কিছুদিন ছিলেন।”

আরও বলেন, “ইউনিভার্সিটিতে আমি রাজনীতি করতাম, সোশ্যাল সেক্রেটারি ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে জিতেছিলাম। তখন মুসলমান ছাত্র তো আমরা মাত্র চার-পাঁচজন। তার পরও আমি অনেক ভোটে জিতে গেলাম।”

“এর পরেরবার সবাই মিলে আমাকে হারাবে বলে ঠিক করল। আমার কাজ ছিল ছাত্রদের বই, ক্যানটিন ট্যুরের ব্যবস্থা করা। তখন রাস্তার পলিটিকসে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যুব কংগ্রেস করতাম। কংগ্রেস বলতে ন্যাশনাল পলিটিকস না। আমি তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন আমার নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সেন্ট্রাল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আর আমি ছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গলে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, বহুবার মিটিং হয়েছে, কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা খুব বড় মিটিং করেছিলাম সল্টলেকে, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বিধান রায় ছিলেন। সে আরেক ইতিহাস। কলকাতায় পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিলেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।”

১৯৬০ সালে কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে বারের সদস্য হন রফিক-উল হক। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে চলে আসেন ঢাকায়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার রফিক। ওই বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদকও পান। বার-অ্যাট-ল করতে গিয়েও ব্রিটেনে সাড়া ফেলেন। খুব ভালো ফল করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। হিন্দু আইন নিয়ে বার-অ্যাট-ল করেছিলেন, সেখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন।

১৯৬৫ সালে হাই কোর্টের আইনজীবী তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান রফিক-উল হক। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়েছিল তাকে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন প্রবীণ এই আইনজীবী। কিন্তু কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো সম্মানী নেননি। প্রতীকী সম্মানী এক টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এক টাকা তুলতে দুই টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে, সে কারণে তাও নেননি। নিজের স্বাধীনতাকে জিম্মি করে কাজ করেননি কখনো। জীবনে যখন যেটাকে ঠিক মনে করেছেন তা,-ই করেছেন। তার ভাষ্যে, “নিজের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে কাজ করিনি কখনো।”

  সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অনেক রাজনীতিবিদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই করে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক।

ব্যারিস্টার রফিক বিভিন্ন সময় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ল পড়ানো শুরু হয়।

সমাজ ও মানবতার সেবায় তার হাত ছিল সব সময়ই উদারহস্ত। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজ-মানবতার সেবায়।

জীবনের উপার্জিত অর্থের সবই ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়। মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিকেল কলেজ। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করছেন। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নুরজাহান ওয়ার্ড, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের চেয়ারম্যান, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান রফিক-উল হক। আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন।

ঢাকায় তার সম্পদ বলতে ছিল একটি বাড়ি আর দু-তিন কাঠার একটি প্লট। ব্যারিস্টার রফিক বলেছিলেন, “আমি আমার উত্তরসূরিদের জন্য একটি টাকাও ব্যাংকে রেখে যেতে চাই না। মানবতার সেবায় সবকিছু ইনভেস্ট করতে চাই।”

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিকিৎসক স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১ সালে। রফিক-উল হকও ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। স্টমাক ক্যানসার হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে অপারেশন হয় তার।

গত ১৫ অক্টোবর রফিক-উল হককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডা. রিচমন্ড রোল্যান্ড গোমেজের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তার বাম পায়ে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর থেকে স্বাভাবিক হাঁটাচলা ব্যাহত হওয়ায় হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতেন। বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কয়েক বছর ধরেই সুপ্রিম কোর্টে অনিয়মিত ছিলেন তিনি। আজ আদ-দ্বীন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক আইন পেশায় জড়িত।

সূত্র : দেশ রুপান্তর

 

উপরে