ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
আপডেট : ১৭ অক্টোবর, ২০২০ ১১:০১

রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুত ভাসানচর

নিরাপদ আবাসন, স্বচ্ছন্দময় জীবনযাপনের পাশাপাশি থাকছে জীবিকা নির্বাহের সুবিধা
অনলাইন ডেস্ক
রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুত ভাসানচর

প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার জীবন ও জীবিকার জন্য শতভাগ প্রস্তুত ভাসানচর। নিরাপদ আবাসন ও স্বচ্ছন্দময় জীবনযাপনের জন্য প্রায় সব উপাদানই রাখা হয়েছে এখানে। তৈরি করা হয়েছে আবাসিক ভবন, বাজার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, থানা, সুপার শপ, অফিস ও শেল্টার হাউস। পাশাপাশি আছে জীবিকা নির্বাহের নানা সুবিধা। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের এই ভাসানচরের বিশাল কর্মযজ্ঞের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা। স্বাভাবিক যাতায়াতের জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথের স্টপেজ করার চিন্তা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পর ভাসানচরকে দেশের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দিয়ে দেওয়ার। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, একসময়ের প্রত্যন্ত চরকে আমূল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যেখানে কিছু গাছ আর কয়েকটি মহিষ ছাড়া কিছু ছিল না, সে চরকে এখন চোখ-ধাঁধানো আর্কিটেকচারাল প্ল্যানে নতুন রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রায় ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে নেওয়া এ প্রকল্পের সব কাজই শেষ। এখন যে কোনো সময় এখানে ১ লাখ ১ হাজার ৬০ জন গিয়ে বসবাস করতে পারবে। এক রুমে চারজনের থাকার জন্য দ্বিতল বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন ১৬টি রুম, নারী-পুরুষের জন্য আলাদা বাথরুম, টয়লেট ও রান্নাঘর নিয়ে বানানো হয়েছে একেকটি বাড়ি। এমন ১২টি করে বাড়ি নিয়ে একেকটি পাড়া বানানো হচ্ছে। পাড়াগুলোকে বলা হচ্ছে ক্লাস্টার। বিশাল এ প্রকল্পে এমন ১২০টি ক্লাস্টার বানানো হয়েছে। প্রতি ক্লাস্টারে দুর্যোগ সময়ের জন্য বানানো হয়েছে চার তলার একটি করে শেল্টার। ২৬০ কিলোমিটার গতির ঝড়েও অটুট থাকবে এসব শেল্টার। দুর্যোগে ১ হাজার মানুষ ও ২০০ গবাদি পশু আশ্রয় নিতে পারবে শেল্টারগুলোয়। তবে স্বাভাবিক সময়ে বসবাস করবে ৯২ জন এবং আয়োজন হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রাথমিক শিক্ষার। এমন মোট ১০০ শেল্টার হাউস আছে ভাসানচরে।

প্রাথমিকভাবে শেল্টার ভবন হিসেবে তৈরি হলেও ২০টি চার তলা ভবনকে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন কাজে। এর মধ্যে দুটি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে সব ধরনের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকছে এসব হাসপাতালে। এর বাইরে আরও চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে চারটি চার তলা ভবনে। একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভবন তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের অফিস ও বাসস্থান হিসেবে। আলাদা ভবন থাকছে রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট প্রতিনিধিদের জন্য। আরেকটি চার তলা ভবনে অফিস ও বাসস্থান থাকছে আরআরআরসি ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের। থাকছে একটি ভবনজুড়ে মাল্টিপারপাস সুপার শপ। পুলিশের একটি পূর্ণাঙ্গ থানা ও একটি ফাঁড়ি থাকছে দুই ভবনে। থাকছে দুটি চার তলা স্কুলভবন। তিনটি চার তলা মসজিদও থাকছে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের জন্য। তৈরি হয়েছে দুটি এতিমখানাও। ডে-কেয়ার সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্যও রয়েছে আলাদা ভবন। গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের জন্য তৈরি হয়েছে নান্দনিক একটি গেস্টহাউস। এ ছাড়া নেভির অফিসার ও নাবিকদের জন্য ব্যবহার হচ্ছে দুই নিরাপত্তা ভবন। প্রকল্প এলাকার ভিতরে যাতায়াতের জন্য বানানো হয়েছে ৪২ কিলোমিটার পাকা ও হেরিংবোন রাস্তা। আছে দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হেলিপ্যাড।

ক্লাস্টারগুলো ঘুরে দেখা যায়, সরাসরি বিদ্যুতের লাইন না থাকায় সোলার ও জেনারেটরে উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ভাসানচরকে। তাই আবাসিক কক্ষগুলোর ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যেন প্রাকৃতিক বাতাসের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা যায়। ফলে কক্ষগুলোয় প্রয়োজন হবে না ফ্যান। অবশ্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হাইব্রিড সোলার পাওয়ার প্লান্ট, ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর ও দুটি ৫০০ কিলোওয়াট ডিজেল জেনারেটর বসানো হয়েছে। ভাসানচরে আশ্রিতদের রান্নাবান্নার জন্য প্রায় ৩ হাজার চুলা বসানো হয়েছে রান্নাঘরগুলোয়। ১ লাখ লোকের জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার ১২৫ টন জ্বালানির প্রয়োজন হবে। এ জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার হলে আশপাশে বনভূমি উজাড় হওয়ার শঙ্কা থাকায় জ্বালানি হিসেবে চারকোল বা কাঠকয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া বসানো হয়েছে আড়াই শ বায়োগ্যাস প্লান্ট। ভাসানচরে একসঙ্গে তিন মাসের খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সেই সঙ্গে ত্রাণসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ২০৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে চারটি সুবিশাল ওয়ারহাউস বানানো হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে ৫১.৮ কিমি, হাতিয়া থেকে ২৪.৫ কিমি ও সন্দ্বীপ থেকে ৮.৩ কিমি দূরের ভাসানচরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এজন্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৭২ বছরে হওয়া সব ধরনের ঝড়ের ডাটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১০ হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৯ ফুট উচ্চতার ১২.১ কিমি বাঁধের নির্মাণ শেষ হয়েছে। এ বাঁধকে আট স্তরে কমপেকশন করা হয়েছে। বাঁধে রয়েছে ১৮টি স্লুইস গেট। বাঁধ থেকে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বনায়নও হয়েছে। ধীরগতির ভাঙন প্রতিরোধে ৪০০-৫০০ মিটার দূরে ওয়েভ স্ক্রিন পাইলিং, গ্র্যাভেল স্থাপন ও জিও ব্যাগসংবলিত তিন স্তরের প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরডিপিপি অনুযায়ী ৯ থেকে ১৯ ফুট বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ গত জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছর ধরে ১৪-১৫ হাজার শ্রমিক প্রকল্প এলাকায় কাজ করছেন। নির্মাণকাজে গতি আনতে ৩০টি আলাদা প্যাকেজে ৩০ জন ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানো হয়। নৌবাহিনীর আনুমানিক ২০০ সদস্য ও কনসালট্যান্টের ইঞ্জিনিয়াররা নির্মাণকাজ তদারকি করেন। ভাসানচর প্রকল্প বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ স্থাপনাসমূহের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে ইউকেভিত্তিক কোম্পানি এমডিএম আর্কিটেক্টস। এ ছাড়া সমুদ্রতীর ও বাঁধসংক্রান্ত অঙ্গসংস্থানবিদ্যা অধ্যয়ন এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে ব্রিটিশ কোম্পানি এইচআর ওয়ালিংফোর্ড। প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, ভাসানচর মোট ১৩ হাজার একরের হলেও মাত্র ১ হাজার ৭০০ একর জমির চারদিকে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের ওপর আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা করা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইজের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। আরও ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফলে এখন ১ লাখ রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পর চাইলে পুরো ১০ লাখকেই ভাসানচরে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

রয়েছে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাও : বর্তমানে রোহিঙ্গারা ত্রাণ সহায়তা কার্ডের আওতায় খাবার ও রেশন পাওয়ায় তাদের জন্য তেমন কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেই। কিন্তু ভাসানচরে পরীক্ষামূলক জীবিকা নির্বাহ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে আছে মাছ চাষ, স্থানীয় মুরগি এবং টার্কি মুরগির চাষ, ভেড়া পালন, গবাদি পশু পালন, কবুতর ও হাঁস পালন, দুগ্ধ খামার, ধান ও সবজি চাষ, হস্তশিল্প, মহিলাদের জন্য সেলাই কাজ, বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং, ট্যুরিজম এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। দ্বীপে এখন প্রায় ৬ হাজার মহিষ আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এসব মহিষের পাশাপাশি সরকারিভাবে প্রকল্প নিয়ে মহিষের দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এখন ছাগল ও ভেড়া পালনের যে পরীক্ষামূলক উদ্যোগ চলছে সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ভালো দেখা গেছে। প্রকল্পের দুটি বিশাল লেকে পরীক্ষামূলকভাবে মাছ চাষ করেও সফলতা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া খালি থাকা বিশাল জমিতে যে কোনো ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

 

উপরে