ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
আপডেট : ৫ অক্টোবর, ২০২০ ১৩:০২
সূত্র :

১৭৮টি নদী খনন

নৌ-পথ উন্নয়নে যুগান্তকারী উদ্যোগ ১০ হাজার কিলোমিটার স্থায়ী নাব্যতা পাবে গৃহিত প্রকল্পে ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা
অনলাইন ডেস্ক
১৭৮টি নদী খনন

‘বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের/ হাহাকার শুনেও/ নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা/ তুমি গঙ্গা বইছ কেন’ (ভূপেন হাজারিকা)। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীর এই গান শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানবতার শিল্পী দেশের নদীগুলোর ওপর অন্যায়-অবিচারের চিত্র তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করে গঙ্গার কাছে জানতে চান, তবুও তুমি বইছ কেন? নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেন- ‘ও নদী রে/ একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে/ বল কোথায় তোমার দেশ/ তোমার নেই কি চলার শেষ’। নদীর অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখে কবি লিখেছেন, ‘আমার যেতে ইচ্ছে করে নদীটির ওই পাড়ে’।

প্রকৃতির দান আল্লাহর নেয়ামত দেশের সেই নদীগুলোকে ধ্বংস করেছে প্রতিবেশি ভারত নদীর পানি আটকে দিয়ে। এ ছাড়াও দেশের কিছু নদীখেকো, ভূমিখেকো নদী দখল করেছে। অথচ বাংলাদেশে নদী ও নৌকার প্রাকৃতিক নৈসগিক অপরূপ মায়াময় দৃশ্য কে না দেখেছে? দেরিতে হলেও সেই নদীগুলোকে উদ্ধার এবং খননের মাধ্যমে ‘ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ’ ফিরিয়ে আনা এবং নদীপথকে আরো সম্প্রসারণের উদোগ নিয়েছে সরকার।

রেল, সড়কপথ উন্নয়নের পাশাপাশি এবার নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে দেশের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে নৌপথ বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ড্রেজিং মাস্টার প্ল্যানের আওতায় ১৭৮টি নদী খনন এবং পুনঃউদ্ধার করে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প ২০২০-২০২১ সালে শুরু হয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করা হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমুদ্রবন্দরগুলো থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করা যাবে। এবং কৃষকের ফসল উৎপাদনে সেচ সুবিধা ও মাছ চাষ বৃদ্ধি পাবে।

সারাদেশে বর্ষাকালে নৌপথের পরিমাণ ছয় হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে তা কমে দাঁড়ায় চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটারে। গত ১০ বছরে সবমিলিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করার সক্ষমতা ফিরে আসতে হবে বলে মনে করছেন নৌবিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশের নৌপথের উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রল্পের কাজ শেষ হলে গোটা নৌ-যোগাযোগ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলে সমুদ্রগামী ছয়টি বড় জাহাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল ক্ষমতায় আসার পরে দেশের বেহাল নৌ-পথের উন্নয়নে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাস্তবায়নের গতিমন্থর হলেও আগের সরকারগুলোর চেয়ে নদীপথ রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে তার গতি বেড়েছে। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দশ বছরে এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নৌ-পথ খনন করেছে। এর ফলে বর্তমানে নৌ-পথ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৬০০ কিলোমিটারে।

সারাদেশের আরও ১৭৮টি নদীর ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ খননের কাজ চলমান রয়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর তীর থেকে প্রায় ১২ হাজার ৩৯৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ৩৭২ দশমিক ১২ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভ‚মি থেকে প্রায় দুই হাজার ৭৭৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ১৯৪ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব এলাকায় উচ্ছেদের পর পুনর্দখল রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নদীর উভয় তীরে ওয়াকওয়ে, আরসিসি স্টেপস, বসার বেঞ্চ, ইকোপার্ক নির্মাণ, নদীর পাড় বাঁধাই, গাইড ওয়াল নির্মাণ, বৃক্ষরোপণের কাজ শুরু করেছে।

দেশের ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথের নাব্য বাড়ানোর খসড়া মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায় সংস্থাটি। প্রকল্পের খসড়া পরিকল্পনায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে হাওর, পার্বত্য ও দক্ষিণাঞ্চলের ৮০টি নদ-নদী। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনা বিভাগে রয়েছে অর্ধশত নদী খনন। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। নৌপথ খনন করার মতো সক্ষমতা ও জনবল না থাকলেও ড্রেজিং কার্যক্রমের তদারকিও করবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

এর আগে নদী খননের আগে ও পরে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে রেকর্ড রাখা বাধ্যতামূলক করে একটি পরিপত্র জারি করেছে। এ পরিপত্রে নদী খননে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ১৬ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ অর্থায়নে দুই দেশের নৌ প্রটোকলভুক্ত ৪৭০ কিলোমিটার নৌপথের খনন কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় কালনি ও কুশিয়ারা নদীর আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ নৌপথের ২৮৫ কিলোমিটার এবং যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়ার ১৮৫ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে।

সারাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের দৈর্ঘ্য বর্ষাকালে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে এটি ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে আসে। নৌ-যান যাতে বাধাহীনভাবে সবসময় চলাচল করতে পারে সে নতুন করে সংস্কারে উদ্যাগ নিয়েছে সরকার। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের ৩৯টি নৌ-যান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া উপক‚লীয় এলাকার সাধারণ মানুষের চলাচল দ্রুত ও সহজতর করতে এ প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ এ বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন হলে দেশের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে।

সমুদ্রবন্দরগুলো থেকে নৌপথেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করা যাবে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে সেচ সুবিধা ও মাছ চাষ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এগুলোর আওতায় তিন হাজার ৩১৫ কিলোমিটার নদী খনন কাজ চলছে। আরও দুটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ দুটি প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৩৯৩ কিলোমিটার খননের কাজ শুরু হবে। নতুন-পুরাতন সব প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৫০০ কিলোমিটার নৌ-পথ খনন করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর এক পরিচালক ইনকিলাবকে বলেন, সরকারের দুটি পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমত, ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে চলাচলের উপযোগী করা। দ্বিতীয়ত, ১০ হাজার কিলোমিটার নদী খনন করা। ঢাকার চারপাশের নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ হয়ে বরিশাল পর্যন্ত ৯৬০ কিলোমিটার নৌ-পথ উন্নয়নে খনন কাজ আগামী বছর শুরু হচ্ছে। এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা- এই চার নদীর ৪৯৩ কিলোমিটার খননে চার হাজার ৩৭১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাস। গোমতী নদীর ৯৫ কিলোমিটার খননে ৭৯৭ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদী খনন ও বন্যা ব্যবস্থপনায় চার হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। সাঙগু, মাতামুহুরী ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ পর্যন্ত ২৫২ কিলোমিটার নৌ-পথ খনন ও পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা যাচাই-বাচাই করা হয়েছে। এসব নদী খননে এক হাজার ৩১৩ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পার্বত্য তিন জেলার ১২টি নদীর ৭০০ কিলোমিটার খননে সমীক্ষা যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। এ ১২টি নদী খননে চার হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। খুলনা বিভাগের ১২টি নদীর ৬৫০ কিলোমিটার খনন, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে সাত হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে ডিপিপি প্রস্তাবে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

বরিশাল বিভাগের ৩১টি নদী খনন, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় নতুন ডিপিপি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর বাইরে আগামী অর্থবছরে আরও ৪৭টি নদী খননের জন্য সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটির বহরে ৩৫টি ড্রেজার রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি প্রায়ই নষ্ট থাকে। নতুন করে ৪৫টি ড্রেজার সংগ্রহ করা হচ্ছে। বহরে থাকা ৩৫টি ড্রেজারে প্রয়োজনের তুলনায় ৩০/৪০ শতাংশ জনবল কম রয়েছে। ফলে এসব ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অপরদিকে প্রতিবছর নদী রক্ষণাবেক্ষণে এক কোটি থেকে এক কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করতে হচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় নদী খননে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়েছে।

পরিপত্রে বলা হয়েছে, নদী খননের পলি কোনোভাবেই নদীতে ফেলা যাবে না। নদী খননের আগে ও খননের পরে যৌথ জরিপ করতে হবে, যাতে নির্ধারিত গভীরতা অর্জিত হয়েছে কিনা তা যাচাই করা যায়। তীর ও ঢাল যথাযথ সংরক্ষণ করে নদীর তলদেশে সুষম খনন করতে হবে। যত্রতত্র খনন করা যাবে না। খননের পলি স্ত‚পাকারে রাখতে হবে যাতে তা নদীতে ধুয়ে নামতে না পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।

মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ এই চার নদীর যে সব স্পটে নাব্য সঙ্কট রয়েছে সেখানে খনন, বর্জ্য উত্তোলন, নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়াও বন্দরগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এক হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নৌপথ খনন) প্রকল্পের আওতায় ২৪টি নদী খননের কাজ চলছে। এর আওতায় দুই হাজার ৪৭০ কিলোমিটার নৌপথ উন্নয়নে কাজ চলছে।

এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ৫০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২টি নদীর ৬৩৫ কিলোমিটার ও ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মংলা থেকে চাঁদপুর হয়ে রূপপুর পর্যন্ত নৌ-পথ খনন কাজ চলছে। বাকি নৌ-পথ সরকারের এ মেয়াদে বাস্তবায়নের নতুন নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

তবে নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা বলছেন, নদী খনন করে নাব্যতা আনার পাশাপাশি নদীখেকো ও দখলদাররা যাতে আবারও নতুন করে দখল করতে না পারে সে লক্ষ্যে তদারকির কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।

 

উপরে