পদ্মা সেতুর নকশায় বারবার ত্রুটি কেন
পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত নকশায় ত্রুটি ধরা পড়েছে বেশ কয়েকবার। এসব ত্রুটির কারণে নকশা সংশোধন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয়—দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক হারে। ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকায় শুরু হয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। অন্যদিকে সময়সীমা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালেও সেতুটির কাজ শেষ হবে কিনা, সে বিষয় নিয়েও সংশয় রয়েছে।
শুরুতে পরিকল্পনা ছিল পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এজন্য সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনতে হয়। ব্যয়ও বাড়ে। নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০১৫ সালে শুরু হয় বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। এর পর পরই দেখা দেয় নকশায় ত্রুটি। ফলে ২২টি পিয়ারের (খুঁটি) নকশা বদলে ফেলতে হয়। এ নকশা সংশোধন করতেই লেগে যায় কমবেশি দুই বছর। বাড়াতে হয় ব্যয়ের পরিমাণও।
পদ্মা সেতু চালুর দিন থেকেই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এজন্য আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানো হচ্ছে। গত বছর এ রেললাইনের ভায়াডাক্টের পাইল নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। ফলে পাইলের নকশা পরিবর্তন করতে হয়। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর সংযোগস্থলে রেললাইনের উচ্চতা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। আপাতত এ নকশা সংশোধনের কাজ চলছে। ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এরই মধ্যে রেললাইনের নির্মাণব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায়। নকশায় নতুন জটিলতা প্রকল্পটির ব্যয় আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাগজ-কলম থেকে বেরিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ মাঠে গড়ায় ২০১৫ সালে। এর কিছুদিন পরই সেতুর ১৪টি পিয়ারের নকশা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। ১৪টি পিয়ার নদীর যে জায়গায় নির্মাণের কথা ছিল, সেখানে নদীর তলদেশে নরম মাটির স্তর পাওয়া যায়। অভিযোগ ওঠে, সেতুর নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান মনসেল এ জায়গায় মাটির গুণাগুণ ঠিকমতো পরীক্ষা করেনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এক প্রতিবেদনে অভিযোগটি তোলে।
প্রায় দুই বছর লেগে যায় পিয়ারগুলোর নকশা সংশোধন করতে। সংশোধিত নকশায় প্রতিটি পিয়ারে ছয়টির বদলে সাতটি করে পাইল করার পরামর্শ দেয়া হয়। সব মিলিয়ে সেতুর ২২টি পিয়ারের নকশায় পরিবর্তন করা হয়। এ নকশা সংশোধনের কাজ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
পদ্মা সেতুর নকশার এ জটিলতার দায় আসলে কার, জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট টিমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীম জে বসুনিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমি এখানে কারো দায় দেখি না। সমস্যাটি হয়েছিল মাটির তলদেশে নরম কাদামাটির স্তর থাকা নিয়ে। এটি পরে সমাধান করা হয়েছে। ২২টি পিয়ারে ছয়টির বদলে সাতটি করে পাইল করতে হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নকশা সংশোধনের জন্য পরামর্শক নিয়োগ ও পরে বাড়তি পাইল যুক্ত করায় সেতুর ব্যয় প্রত্যক্ষভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে এ কারণে প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গিয়েছে নির্মাণকাজ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও অতিরিক্ত পাইলের কারণে সেতুর ব্যয় যতটা না বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাওয়ায়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) একই রকম মন্তব্য করেছে। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, সেতুর পাইল ডিজাইন পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। সময় বর্ধিত হয়। ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতুর ৪২ পিয়ারের মধ্যে ২২টিতে একটি করে অতিরিক্ত পাইল সংযোজন করে পিয়ারের নতুন নকশা প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ায় সিডিউল অনুযায়ী নির্মাণকাজ ব্যাহত হয়েছে। আর সেতুটির নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে পরামর্শকদের পেছনেই এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। এ সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বেড়েছে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়ও। লাগছে বাড়তি জনবল।
নানা জটিলতা পেরিয়ে এখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে পদ্মা সেতুর কাজ। সেতু বিভাগের দাবি, মূল সেতুর কাজ প্রায় ৯০ শতাংশই শেষ। মূল সেতুর নির্মাণকাজ যখন শেষের দিকে তখন এ প্রকল্পে নতুন করে জটিলতা তৈরি করেছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। পদ্মা সেতুর রেললাইনটি নির্মাণ করা হচ্ছে সংযোগ সড়কের ওপর দিয়ে। কিন্তু যে প্রান্তে সংযোগ সড়কের ওপর দিয়ে রেলপথটি অতিক্রম করেছে, সেখানে রেলপথটির প্রয়োজনীয় উচ্চতা রাখা হয়নি। এতে সংযোগ সড়ক দিয়ে যান চলাচল বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন প্রকৌশলীরা। এ কারণে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের নকশা সমন্বয় করা হচ্ছে।
সম্প্রতি পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ প্রকল্পের এসব ত্রুটিপূর্ণ স্থান পরির্দশন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। নির্মাণ ও নকশায় এসব ত্রুটির বিষয়ে সেখানে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, এত বড় প্রকল্পের পদে পদে সমস্যা হতেই পারে। সেতু চালু হওয়ার আগেই এটি চিহ্নিত করা গেছে। তাই এটি সহজেই সমাধান করা যাবে বলে আমরা আশা করছি।
এ সময় সমস্যাগুলো নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে আলোচনা করার কথাও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
নকশার ত্রুটির বিষয়টি সমাধানে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, রেললাইনের নকশা সংশোধনের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্টের প্রধান অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়াকে। তার নেতৃত্বে একটি দল নকশা সংশোধনের কাজটি এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
গতকাল এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, সমস্যাটি খুব বেশি বড় না। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন করেই এটা সমাধান করা সম্ভব। আমরা এরই মধ্যে নকশার এ পরিবর্তন চূড়ান্ত করে ফেলেছি।
এমন সমস্যা দেখা দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমস্যাটি আসলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের। রেললাইনের অ্যালাইনমেন্ট তৈরি করার সময় আরেকটু সতর্ক থাকলে এটি এড়ানো যেত।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ থেকে ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনুমোদন হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প। প্রাক্কলিত নির্মাণব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০১১ সালে প্রথমবার প্রকল্পটির সংশোধন আনা হয়। নকশা পরিবর্তন করে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, রেললাইন সংযোজনসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাড়িয়ে নির্মাণব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অপরিবর্তিত রাখা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ।
বাস্তবায়ন কাজ বিলম্ব হওয়ায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ব্যয় বাড়ানো হয় দ্বিতীয় দফায়। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় ডিপিপি সংশোধন করা হয়। তবে নকশা জটিলতা কাটিয়ে কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় ২০১৮ সালের জুনে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ডিপিপি তৃতীয়বার সংশোধন করা হয়। নির্মাণব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পরের বছর ফের ডিপিপি সংশোধন করে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণব্যয় আরেক দফায় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান আছে।
অন্যদিকে রেল সংযোগ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পটির নির্মাণব্যয় শুরুতে ছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। বর্তমানে তা ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ। নকশায় নতুন করে ত্রুটিটি সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় ও সময়—দুটোই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।