এবার ফাঁস ফিনসেন নথি, বাংলাদেশের সন্দেহজনক আট লেনদেনের তথ্য
গত দুই দশকে বিপুল অংকের সন্দেহজনক তহবিল লেনদেন হওয়ার নতুন এক কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এই লেনদেন করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংকের নামও। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট ইন্টারন্যশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নলিস্টস-আইসিআইজে এই বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে।
ফিনসেন ফাইলস নামের এই নথিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। সেগুলো ঘটেছিল ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারি বা আর্থিক দপ্তরের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের কাছে নিয়ম অনুযায়ী এসব সন্দেহজনক অবৈধ অর্থ লেনদেনের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
এই অর্থ কোথা থেকে কোথায় স্থানান্তর হয়েছিল তার ১৮ হাজার ১৫৩ টি নমুনা ওয়েবসাইটে আলাদাভাবে দেখিয়েছে আইসিআইজে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এবং বাংলাদেশে আসা আটটি লেনদেনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। এই লেনদেনগুলো হয়েছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে, যার পরিমাণ আট লাখ ৩২ হাজার ৯৩৭ ডলার। টাকার অঙ্ক যা সাত কোটির বেশি। এর মধ্যে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এসেছে তিন লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৩ ডলার, যার তিন লাখ ৩৬ হাজার ১৩৩ ডলারই ঢুকেছে দেশের একটি ব্যাংকে। অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড ব্যাংকিং (এএনজেড) থেকে এই টাকা এসেছে। টাকা স্থানান্তর হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট থেকে এক সেপ্টেম্বরে। লেনদেনগুলো সম্পন্ন হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলন কর্পোরেশনের মাধ্যমে। তারাই এই লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অর্থ পাচার প্রতিরোধ বিভাগকে অবহিত করে। এছাড়াও আরো একটি ব্যাংকের ১৬০০ ডলারের আরেকটি লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল একটি ব্যাংক। ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল লাটভিয়ার একটি ব্যাংক থেকে ওই ব্যাংক হয়ে ওই টাকা দেশের একটি ব্যাংকে এসেছিল।
অন্যদিকে চারটি পৃথক ট্রানজেকশন বা লেনদেনে বাংলাদেশের আরো একটি ব্যাংক থেকে জার্মানির একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে চার লাখ ৯৫ হাজার ডলার স্থানান্তর হয়েছিল। এই লেনদেনটি হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ ও ২২ সেপ্টেম্বর। এই সম্পর্কেও ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের কাছে রিপোর্ট করেছিল বিদেশি একটি ব্যাংক।
আইসিআইজের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাজফিড নিউজের হাতে প্রথম এই নথি আসে। পরবর্তীতে সেটি তারা আইসিআইজেকে দেয়। জোটের ৪০০-র বেশি সাংবাদিক ১৬ মাস ধরে এসব তথ্য ধরে অর্থ পাচার বিষয়ক অনুসন্ধান চালিয়েছেন।
আইসিআইজে বলছে, এই নথির দুই ট্রিলিয়ন ডলারের তথ্য বিশ্বজুড়ে যে অবৈধ লেনদেনের বন্যা বইছে তার একটি ফোঁটা মাত্র। শুধু ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের কাছে মোট যত রিপোর্ট হয়েছে, তার তুলনায় এটি দশমিক শূন্য দুই ভাগ।
পানামা পেপারের ঘটনা এক সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল বিশ্ব জুড়ে। এবার প্রায় সেই একই রকম সাড়া ফেলেছে ফিনসেন ফাইল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর সমস্ত ব্যাঙ্ককে দেখতে হয় তাদের ক্রেতারা যে অর্থ ব্যাঙ্কে রাখছেন বা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অন্য কোথাও পাঠাচ্ছেন, তার উৎস কী? অর্থাৎ যে অর্থ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে, তা বৈধ কি না।
ফিনসেন ফাইলের তথ্য বলছে, ব্যাঙ্কগুলো জানতো, তাদের ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বেআইনি অর্থ, বা অবৈধ অর্থ লেনদেন হচ্ছে। তা সত্ত্বেও তারা তা পাচার হতে সাহায্য করেছে। মূলত পঞ্জি স্কিমের অর্থ এভাবে পাচার হয়েছে। লন্ডন থেকে আমেরিকা বিশ্বের বহু উন্নত দেশ এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। বেশ কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তিও এর সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।
পঞ্জি স্কিমের টাকা এভাবে নয়-ছয় হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গোটা বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্য আইনি ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তো বটেই, যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনায় আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে।