মন্ত্রীকে এড়িয়ে সচিব একাই
কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ব্যয়ে একটি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদনের সিদ্ধান্ত একাই দিয়েছেন জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম। এছাড়া বিদ্যমান নীতিমালা লঙ্ঘন করে বাতিল হওয়া নীতিমালার আওতায় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমোদনও দিয়েছেন তিনি একাই। অথচ এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুমোদনের আগে জ¦ালানি প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি প্রকল্পের বিষয়ে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের। এলপিজি টার্মিনালটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) নামমাত্র অংশীদার (১৫ শতাংশ) করা হয়েছে। বাকি ৮৫ শতাংশ মালিকানা
দেওয়া হচ্ছে দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি, একটি জাপানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানিকে। এলপিজি প্ল্যান্টটি নির্মাণে খরচ হবে ৩১০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এতে দেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টকোস্ট গ্রুপের ২৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি এসকে গ্যাস ইন্টারন্যাশনাল ২৮ শতাংশ ও জাপানি প্রতিষ্ঠান মিতসুইয়ের হাতে থাকবে ৩২ শতাংশ। প্রতি বছর এ টার্মিনাল থেকে ১০ লাখ টন এলপিজি খালাস করতে পারবে। এখান থেকে দেশের সব এলপি গ্যাস কোম্পানি পাইকারিভাবে এলপি গ্যাস কিনে তা বটলিং বা বোতলজাত করে খুচরা বাজারে বিক্রি করবে।
পাইকারি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বিপিসির হাত থেকে চলে গেলে এলপি গ্যাসের বাজারে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া এলপি গ্যাসের বাজার প্রতিযোগিতামূলক রাখতে এ ধরনের টার্মিনালের ওপর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসির নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকা দরকার। তবে টার্মিনালে বিপিসির মালিকানা থাকছে মোটে ১৫ শতাংশ। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিপিসির মতামত তেমন গুরুত্ব পাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বা বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সরকার যৌথভাবে কোনো বিনিয়োগ করলে সাধারণত সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মতো জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সেবায় সরকারের অধিক নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি। এ কারণে এসব খাতে যৌথ বিনিয়োগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অন্তত অর্ধেক মালিকানা রাখার একটি রেওয়াজ আছে। এ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের নেওয়া রামপাল, পায়রাসহ বিভিন্ন যৌথ প্রকল্পের সবগুলোতেই সরকারি কোম্পানির ৫০ শতাংশ মালিকানা হাতে রাখা হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের জ¦ালানি বিভাগ এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পে বিপিসিকে দিচ্ছে ১৫ শতাংশ মালিকানা। তারা বলছেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এলপিজি টার্মিনাল স্থাপন করা হলে বিপিসির মালিকানা আরও অনেক বেশি পাওয়ার সুযোগ থাকত। টার্মিনাল পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিপিসির গুরুত্ব না থাকলে এলপিজির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জ¦ালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘না জেনে কথা বলবেন না। আগে জানুন, পরে কথা বলেন। মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলেন।’
গতকাল যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর ছাড়া এলপিজির বটলিং প্ল্যান্টের নকশা অনুমোদন!
জ¦ালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম ইউনাইটেড নামের একটি বেসরকারি এলপিজি কোম্পানির প্ল্যান্টের নকশার অনুমোদন দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর সই ছাড়া। ওই নকশা অনুমোদন দিতে গিয়ে বিদ্যমান নীতিমালা এড়িয়ে গিয়ে সুবিধা দেওয়া হয়েছে বাতিল হওয়া পুরনো নীতিমালায়। ২০১৬ সালে এলপিজি নীতিমালা হওয়ার পরও ২০০৪ সালের পুরনো নীতিমালার আওতায় গত বছর ১৬ অক্টোবর নকশা অনুমোদন করেন সচিব।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও জ¦ালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেড ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রাথমিক অনুমোদন পায়। পরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়ায় ৩ লাখ টন ধারণক্ষমতার (দেড় লাখ করে দুটি) এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমতি চেয়ে ২০১৭ সালে বিস্ফোরক অধিদপ্তরে আবেদন করে। পরে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট আবারও বিস্ফোরক অধিদপ্তরে আবেদন করে তারা। তাতে পুরনো নীতিমালা অনুযায়ী নকশা অনুমোদন চায় ইউনাইটেড এলপিজি।
আবেদন পাওয়ার পর তা পরীক্ষা করে বিস্ফোরক অধিদপ্তর জ¦ালানি বিভাগকে জানায় যে, বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী দেড় লাখ টন ধারণক্ষমতার দুটি স্টোরেজ ট্যাংকের মাঝে দূরত্ব থাকতে হবে ১২০ মিটার। তবে ইউনাইটেড এলপিজির দাবি, তারা যেহেতু প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছে ২০১৬ সালে, তখন (এলপিজি বিধিমালা ২০০৪ অনুযায়ী) এ দুটি স্টোরেজ ট্যাংকের মধ্যবর্তী দূরত্ব রাখার বিধান ছিল ৩০ মিটার। ফলে ইউনাইটেড এলপিজির ক্ষেত্রে কোন বিধিমালাটি কার্যকর হবে তা বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে জানানো হোক।
‘ইউনাইটেড এলপিজির স্টোরেজ ট্যাংক স্থাপনের ক্ষেত্রে ২০০৪-এর বিধিমালা অনুসরণ করার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে’ মন্তব্যসহ নোটশিট তৈরি করেন জ¦ালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব আকরামুজ্জামান। কম্পিউটারে কম্পোজ করে গত বছর ১৪ অক্টোবর তৈরি করা ওই নোটশিটের ‘পরামর্শ দেওয়া’ শব্দ দুটি হাতে কেটে তার বদলে ‘বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে বলা যেতে পারে’ মন্তব্য লিখে তাতে পরদিন সই করেন ওই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আহসানুল জব্বার।
পরদিন ওই নোটশিটে সই করেন জ¦ালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম। তিনি ‘বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে বলা যেতে পারে’ এমন পরামর্শ না দিয়ে নোটশিটে লেখেন, ‘প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো, সে মতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে জানিয়ে দিন।’ এ নোটশিটে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী নোটশিটটি সচিব সই করার পর প্রতিমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কথা ছিল। প্রতিমন্ত্রীর সই ছাড়া বটলিং প্ল্যান্টের নকশার অনুমোদন হওয়ার সুযোগ নেই। তবে বাস্তবে তাই হয়েছে।
জ¦ালানি সচিবের অনুমোদনের পর গত বছর ২০ অক্টোবর উপসচিব আকরামুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শককে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইউনাইটেড এলপিজির ক্ষেত্রে ২০০৪ সালের বিধিমালা অনুসরণ করে অনুমোদন দিতে হবে। বিপিসিকে ১৫% মালিকানা দিয়ে তড়িঘড়ি নীতিগত অনুমোদন!
মহেশখালী-মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় বিপিসির সঙ্গে যৌথভাবে দেশি-বিদেশি তিন কোম্পানি ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. শামসুর রহমানের কাছে গত ৮ মে। যৌথ কোম্পানির পক্ষে মিতসুই মহাব্যবস্থাপক কেনতারাও হেরামার কাছ থেকে দরপত্রবিহীন অযাচিত এ প্রস্তাব পাওয়ার পর বিপিসির চেয়ারম্যান শামসুর রহমান প্রস্তাবকারী তিন কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৫ মে বৈঠক করেন। বৈঠকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বিপিসিকে ১০ শতাংশ মালিকানা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
গত ২৬ মে বিপিসির চেয়ারম্যান ওই বৈঠকের বিষয়ে অবহিত করে জ¦ালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীমকে চিঠি দেন। তাতে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, যৌথ কোম্পানিতে বিপিসিকে ১০ শতাংশের বেশি মালিকানা দিতে রাজি হয়নি তিন কোম্পানি। যৌথ উদ্যোগের এ কোম্পানিতে অংশীদারত্বের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সভার কার্যপত্র পাঠানোর কথা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া টার্মিনাল নির্মাণে ৫০ থেকে ৬০ একর জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) মাধ্যমে বিপিসির অনুকূলে বরাদ্দ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
ওই চিঠি পাওয়ার পর গত ২৯ মে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক আহ্বান করেন জ¦ালানি সচিব। সচিবের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিপিসির চেয়ারম্যান, জ¦ালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পারভিন আখতার, যুগ্ম সচিব মো. জহির রায়হান, উপসচিব মুহা. মনিরুজ্জামান। এছাড়া মিতসুই, ইস্টকোস্ট গ্রুপ ও এসকে গ্যাসের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় জ¦ালানি সচিব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের অনুমোদন দেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ যৌথ কোম্পানিটির মালিকানার ১৫ শতাংশ বিপিসি, ৩২ শতাংশ মিতসুই, ২৮ শতাংশ এসকে গ্যাস ও ২৫ শতাংশ ইস্টকোস্ট গ্রুপের নির্ধারিত হতে পারে। জ¦ালানি সচিব পদাধিকার বলে ওই কোম্পানিটি চেয়ারম্যান থাকবেন। এ বিষয়ে চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে। বিপিসিসহ দেশি-বিদেশি পক্ষগুলো আলোচনা করে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি করে তা অনুমতির জন্য জ¦ালানি বিভাগে পাঠাবে। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয় যে, বিপিসি যৌথ মালিকানা স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে।
জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যৌথ কোম্পানি গঠনের অনুমতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকল্পের সার-সংক্ষেপ পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। এর আগে বিদ্যুৎ বিভাগে যেসব যৌথ কোম্পানি গঠন করা হয়েছে, তার প্রতিটির ক্ষেত্রেই এমন নিয়ম মানা হয়েছে।
তারা জানান, সাধারণত প্রথমে আগ্রহী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, সেই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশসহ প্রস্তাবটি প্রতিমন্ত্রী অনুমোদন দেন। পরে তা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের এ ক্ষেত্রে যে বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, তার বেলায় এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।