বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ
অবকাঠামো দুর্বলতা, নীতির অস্পষ্টতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি বিনিয়োগ তুলে নিয়ে থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার মতো দেশে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি একটি কোম্পানিও। এমনকি সারা বিশ্ব যখন আইসিটি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করছে, সেখানে আইসিটি খাতেও চাহিদা অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিকে আনতে পারছে না বাংলাদেশ। হাইটেক পার্কগুলোতে হাজার হাজার একর জমি থাকলেও সেগুলোতে দেশীয় কোম্পানিগুলোই বিনিয়োগ করছে। এমনকি নামমাত্র দেশি কোম্পানিও এসব হাইটেক পার্কে একরের পর একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যে কাজ চলছে, সেখানেও গত এক দশকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যৎসামান্যই। তবে জাপান, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) আশা করছে, এসব জোনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিনিয়োগ আসবে। যদিও চীনত্যাগী ৮৭টি জাপানি কোম্পানির একটিও বাংলাদেশে স্থাপিত জাপানিদের জন্য নির্ধারিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে আসেনি, তবে বেজা ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ জাপানি বিনিয়োগ পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এ জন্যই জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার জন্য ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অঞ্চলটি উন্নয়নও করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ২৭০টির মতো। বিগত কয়েক বছরে হোন্ডা মোটর করপোরেশন, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল, নিপ্পন স্টিল অ্যান্ড সুমিতমো মেটাল, মিতসুবিশি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। অন্য দেশগুলো যেভাবে জাপানি বিনিয়োগ পাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে অনেক পিছিয়ে। এমনকি জাপানি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের মতো দেশও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য আকর্ষণের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা রয়েছে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচক বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ৭০, থাইল্যান্ড ২১ ও ইন্দোনেশিয়া ৭৩তম। মিয়ানমারের অবস্থানও বাংলাদেশের তিন ধাপ আগে, ১৬৫তম। ফলে এই সূচকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে কতটা প্রস্তুত।
তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘ওরিক্স বাইয়োটিক নামের একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। তারা আমাদের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুতই তারা সেখানে বিনিয়োগ করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এ খাতে বিপুল সম্ভাবনাও রয়েছে। ১০ বছর আগে দেশের মাত্র ৫৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত। আর এখন প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে।’ ফলে তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারের মাধ্যমেও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন এই প্রতিমন্ত্রী। এ জন্যই আইসিটি খাতের প্রকল্পগুলোর অর্থছাড়কে অগ্রাধিকারভিত্তিক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এদিকে করোনা মহামারীর কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। ফলে সরকারের প্রকল্প ব্যয় পড়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। এ জন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত ছাড়া অন্য সব খাতের প্রকল্প ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। এমনকি সব ধরনের বিলাসী, অজরুরি ভ্রমণ, অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ দুটির খাতের অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হচ্ছে। এ জন্য পৃথিবী এখন হয়ে পড়েছে আইসিটিনির্ভর। ভার্চুয়াল এক জগৎ তৈরি হয়েছে। এ জন্য আইসিটি খাতকে তৃতীয় অগ্রাধিক খাত হিসেবে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়টি। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের যে কোনো ধরনের ব্যয়ের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের অনুমতি চেয়ে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্ভাবনাময় আইসিটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। করোনা মহামারীতে কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্যেও স্বাস্থ্য ও কৃষির পর অগ্রাধিকার খাতের অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে আইসিটি। ফলে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হলেও বাংলাদেশ তা কতটুকু কাজে লাগাতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে। কেননা করোনা মহামারীতেও অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে পারেনি সরকার। অনেকাংশে দুর্নীতি বেড়েছে। এমনকি করোনাভাইরাসে অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে অনেকেই আরও বেশি দুর্নীতি করছেন। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিতই হবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া রয়েছে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোর দুর্বলতা, নীতির অস্পষ্টতা। সাভারে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা হলেও সেখানকার সিইটিপি ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে চামড়া শিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে অন্যান্য খাতেও। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখলেও এ খাতেও নানা সংকট রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ, বেতন-ভাতা অনিয়মিতকরণ নিয়েও প্রায় সব সময়ই শ্রমিক বিক্ষোভ হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অর্থরিটির (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চীন থেকে এখনো কোনো জাপানি কোম্পানি সরেনি। তবে তারা সরার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আশা করি আমাদের এখানেও জাপানি কোম্পানি আসবে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ ধরার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা জমি, পোর্টসহ অন্যান্য অবকাঠামোর অনিশ্চয়তা দূর করছি।’ এদিকে চীন ও আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের জের ধরেই জাপানি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে চীন থেকে। জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৮৭টি কোম্পানির ৫৭টি জাপানে ফিরে যাচ্ছে। আর ৩০টি কোম্পানি চীন ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ওয়েবসাইটে চীন ছেড়ে জাপানের বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকা পাওয়া গেছে। সেই তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০টির মধ্যে ১৫টি কোম্পানি ভিয়েতনাম, ৬টি থাইল্যান্ড, ৪টি মালয়েশিয়া, ৩টি ফিলিপাইন, ২টি লাওস, ১টি ইন্দোনেশিয়া এবং ১টি মিয়ানমার যাচ্ছে (দুটি কোম্পানি কারখানা দুই দেশে নিচ্ছে)। জাপান কারখানা সরাতে যে সহায়তা দিচ্ছে, তা মূলত আসিয়ানভুক্ত (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন) দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য। আঞ্চলিক এই জোটের সদস্য ১০টি দেশ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওস। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আসিয়ান দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে জাপান সরকার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নীতি জটিলতা, অবকাঠামো সংকট আর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব প্রকট। এ জন্যই আমরা বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছি। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এখানে বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা করতে এলে কী ধরনের জটিলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কেও পরিষ্কার জানেন না বিদেশিরা। কী ধরনের জটিলতায় পড়তে হবেÑ এটা জানতে পারলে তাদের একটা প্রস্তুতি থাকত। কিন্তু আমরা তো সেটা পরিষ্কার করতে পারি না। আর আছে নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে এটা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটা মারাত্মক হুমকি। আমরা জাপানিদের ভালো লোকেশন দিয়েছি। সেখান থেকে পোর্ট কাছে। বড় বাজারগুলো কাছে। কিন্তু সেটা তো প্রস্তুত হতে হবে। আমরা তো সেখানেও সময়ক্ষেপণ করছি। মিয়ানমারের মতো দেশ যদি জাপানি বিনিয়োগ টানতে পারে, যেখানে আমরা পারি না, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। অতীতে যেসব কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করতে এসেছে, তাদের অভিজ্ঞতাও তো ভালো নয়। এই যেমন কোরিয়াকে আমরা একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল দিলাম। তারা এলো। কিন্তু তারা আসার আগে ২৫০০ একর জমি দিলাম। আবার আসার পর আমরা তাদের বললাম, ২০০০ একর ফেরত দিয়ে দিতে হবে। তাহলে সে তো থাকবে না। অবশ্যই চলে যাবে। এটা তো অন্য দেশগুলোকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। এখানে জাপান আর কোরিয়াও খুব ঘনিষ্ঠ দেশ। আবার আমাদের পলিসি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যাও রয়েছে। আমরা কী বলছি সেটা আবার পরে ঠিক থাকবে কিনা এটা নিয়েও তো সমস্যা রয়েছে। ফলে এ ধরনের বিষয়গুলো যত দিন থাকবে, বিদেশিরা ভরসা পাবে না।’