করোনাকালে শিশুদের পৃথিবী ‘চার দেয়াল’
করোনার ছোঁয়া লাগার ভয়ে স্কুল বন্ধ সেই মার্চ মাস থেকে। এই চার মাসে অনেকটা চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি শিশুরা। শহর-নগরে স্কুলের বাইরে শিশু পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানাসহ আর যেসব জায়গায় বেড়ানোর জন্য তাদের যাওয়ার সুযোগ ঘটত, বন্ধ সেসবও। যাওয়া নেই দাদাবাড়ি মামাবাড়ি কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীর বাসাবাড়িতে। ভাইরাসের ভয়ংকর ছোবলের ভয়ে এসব বন্ধ থাকার যুক্তির ঊর্ধ্বে শিশুমন হয়ে পড়ছে অবসন্ন। খিটখিটে ভাব ও মেজাজ দেখায় অনেকে; বিনোদনের জন্য শুধু মোবাইল-কম্পিউটারে গেম খেলতে খেলতে জগৎ হয়ে পড়ছে সীমিত। চলাচল নেই বলে দুর্বল হয়ে পড়ছে শারীরিকভাবেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাঁদের কাছে এ সময় নিয়ে আসা বা ফোনে পরামর্শ চাওয়া শিশু-কিশোরদের ১০ শতাংশই ঘরে বন্দি থেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া রোগী।
করোনায় গৃহবন্দি শিশু-কিশোরদের অনেকে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করছে না। অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে থাকছে। অনেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভালো করে কথাও বলছে না। তাদের মধ্যেও ভয়, উদ্বেগ, হতাশা, অবসাদ কাজ করছে। অনেকে রাতে জাগছে, দিনে ঘুমাচ্ছে। মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শারীরিক নড়াচড়া কম হওয়ায় হজমে সমস্যা হচ্ছে, ওজন বাড়ছে। তাদের আচরণে বিরক্ত হয়ে অভিভাবকরা বকা দিলে শিশু-কিশোররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। এতে অভিভাবক ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।
শিশু-কিশোররা বলছে, স্কুলে না যাওয়ায় তাদের পড়ালেখার চাপ নেই। ঘরে বন্দি থেকে একঘেয়েমিতে আগের মতো পড়ালেখা করতে ইচ্ছা করে না। অনলাইনে পড়ালেখায় সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলা যায় না; দেখা হয় না, মনের অনেক কথা আগের মতো বলা হয় না। শিক্ষকদের তেমন প্রশ্ন করা যায় না। ঘরে বসে মোবাইল বা ল্যাপটপ চালানো ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে। মা-বাবা কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারে কোনো সমস্যায় পড়লে অকারণে তাদের বকা দিচ্ছেন। অনেক কর্মজীবী মা-বাবার সন্তানরা জানিয়েছে, করোনার মধ্যে তারা মা-বাবার সঙ্গ কম পাচ্ছে বলে তাদের মন বেশি খারাপ।
রাজধানীর মনিপুর স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাবিলা নওশিন সালেহী কালের কণ্ঠকে বলে, ‘মার্চের মাঝামাঝি থেকে আমাদের স্কুল করোনার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বাসা মিরপুর ১০ নম্বরে। মা-বাবা মাঝে মাঝে আমাদের দুই বোনকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যেতেন।
পাশের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও যেতাম আমরা। এই কয় মাসে সব বন্ধ। করোনা শুরুর পর একজন আত্মীয়ও আমাদের বাসায় আসেনি। আমরাও কারো বাসায় যাইনি। আমি ও আমার ক্লাস টুতে পড়া ছোট বোনের মন খুব খারাপ থাকে। ঘরে বন্দি থেকে পড়ালেখা করতেও একঘেয়ে লাগে।’
কয়েকজন অভিভাবক কালের কণ্ঠকে জানান, করোনার কারণে আর্থিক, স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সংকটে থাকতে হচ্ছে। এর মধ্যে ছেলেমেয়েরা কথা না শুনলে মেজাজ খারাপ হয়। স্কুল বন্ধ হওয়ার প্রথম দিকে তারা কিছুটা পড়ালেখা করলেও এখন ঢিলেমি ভাব। অনেকের মোবাইল বা ল্যাপটপে আসক্তি বেড়েছে। পরিবারের কাজেও সাহায্য করছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, করোনার মধ্যে ঘরবন্দি শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাদের স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা, পড়ালেখা করাতে হবে। তাদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান গোপেন কুণ্ডু কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা ছোঁয়াচে রোগ। বাধ্য হয়েই শিশু-কিশোরদের ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। ঘরে থাকতে বলার মানে এই নয় যে তাদের সারাক্ষণ ঘরে বন্দি করে রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের ছাদে বা মানুষ যেখানে কম আছে এমন খোলা এলাকায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া যায়। টানা ঘরে বন্দি থাকায় তাদের অনেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আমাদের দেশের অনেক পরিবারের বড়রা বুঝতে চান না শিশু-কিশোরদের সমস্যা। তারা তাদের মতো করে ছোটদের চালাতে চান। এটা ঠিক নয়। করোনাকালীন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একজন বড় মানুষের চেয়ে বেশি সমস্যায় আছে শিশু-কিশোররা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—এ পরিস্থিতিতে পরিবারের বড়দের উচিত ছোটদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা এবং গুণগত সময় দেওয়া। গোপেন কুণ্ডু বলেন, শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করে দিনের রুটিন ঠিক করা উচিত। আলাদা সময় নিয়ে তাদের নিয়ে পড়ালেখার জন্য বসাতে হবে। তাদের সঙ্গে দাবা, লুডু বা ক্যারমের মতো খেলা খেলতে হবে। এতে ছোটরা মানসিক ও শরীরিকভাবে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক থাকতে পারবে।
একাধিক পরিবারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার কারণে অনেক পরিবারে আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে। অনেকের বেতন কমানো হয়েছে। ব্যবসায়ে লোকসান যাচ্ছে। এ জন্য অভিভাবকদের মন খারাপ থাকায় অনেকে সন্তানের সঙ্গে কড়া কথা বা খারাপ ব্যবহার করছেন। অনেক কর্মজীবী মা-বাবা সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না। এসব মা-বাবার সন্তানরা আরো নিঃসঙ্গ থাকে। করোনার মতো দুঃসহ পরিস্থিতিতে তারা মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলেও পায় না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনার আর্থিক বা স্বাস্থ্যগত সংকটের জন্য আপনার সন্তান দায়ী না। শিশু-কিশোরদের নিয়ম করে ভালো ভালো বই পড়ে শোনান। বাড়িতে তাদের সঙ্গে ল্যাপটপে শিক্ষণীয় মজার সিনেমা দেখেন। করোনার টেনশন থেকে মুক্ত করতে তাদের আনন্দে রাখতে হবে। নিয়ম করে চলার বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে। রাগ করে বকা দিলে সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে। এতে ভালো কোনো কথা বললেও তা তারা মানবে না।