হাসন রাজার ১৬৬তম জন্মবার্ষিকী
‘লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার- কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’ -অমর গানের রচয়িতা দেওয়ান হাসন রাজার ১৬৬তম জন্মবার্ষিকী আজ।
১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে তেঘরিয়া গ্রামে তার জন্ম। হাসন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার বাবা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তার দ্বিতীয় পুত্র। মায়ের নাম হুরমত জাহান। যিনি ছিলেন নিঃসন্তান বিধবা। তার আগের স্বামী মারা যাওয়ার পর আলী রাজা চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়। এখানেই জন্ম হাসন রাজার। এ সময় তার নামকরণ হয়েছিল অহিদুর রাজা। পরে সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের এক ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে তার নাম হয়ে যায় হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন হাসন রাজা। পরে তিনি হাসন রাজা নামেই খ্যাত হন।
এই মরমি গীতিকার ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। যৌবন ছিল আমোদ-ফুর্তিতে ভরপুর। বিলাসবহুল সৌখিন জীবনে অভ্যস্ত হাসন আসক্ত ছিলেন নারীসঙ্গে। অবশ্য পরিনত বয়সে পৌঁছে আমূল বদলে যান হাসন রাজা। তা এতটাই যে, মানুষের মনের ঘৃণার স্থলটি জয় করে নিলেন ভালবাসায়।
তার ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে কান্দে হাসন রাজার মনমুনিয়া রে’, আবার ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম না কইলাম তার কাম- বৃথা কাজে হাসন রাজায় দিন গুজাইলাম’ আবার ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল- আরে না জানি কি মন্ত্র করি জাদু করিল’ - হাসন রাজার এমন অনেক গান আজো মানুষে মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। বলা যায় চিরন্তন সংগীতে রূপ পেয়েছে হাসন রাজার এসব গান।
অনেকেই মনে করেন লালন শাহ্ এই মরমী সাধনার প্রধান পথিকৃৎ। আর লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।
দেখতে সুদর্শন হাসন রাজা উত্তারিধাকার সূত্রে ছিলেন বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক। হাসন রাজা তার গানে ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বললেও নিজে ভোগ-বিলাসেই মত্ত থেকেছেন। প্রতিবছরই বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত রাখতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হতো।
হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। তিনি ঘোড়া পুষতেন। সৌখিনতার পিছনেই তার সময় কাটতো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠলেন। হাসন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। হঠাৎ করেই আধ্যাত্মিকতায় পেয়ে বসে হাসন রাজাকে। আমূল বদলে যান হাসন রাজা। বদলে যায় তার জীবন দর্শন। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। নিজের ভুল ত্রুটি শোধরাতে শুরু করলেন। রাজসিক পোশাক-আশাক ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা, বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো।
তিনি প্রয়াত হন ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকায় গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে প্রিয়তম মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মরমী কবি হাসন রাজা। যে কবরখানা মৃত্যুর পূর্বেই নিজে প্রস্তুত করেন।