মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এনিমেশন চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম এনিমেশন সিনেমা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে এই এনিমেশন সিনেমা তৈরি করছেন একাধিক অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রে কাজ করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নির্মাতা ওয়াহিদ ইবনে রেজা। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আল আমীন দেওয়ান
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই অর্জনটাই অনুপ্রেরণা। লাঠি-বল্লম নিয়ে ট্যাংকের সঙ্গে লড়াই করেছে এ দেশের মানুষ। ওয়াহিদ ইবনে রেজার বললেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে আন্ডারডগদের এমন বিজয়ের নমুনা খুব কমই আছে। ভিজ্যুয়ালভাবে বলার জন্য এমন বিজয় দুর্দান্ত গল্পের কথা বলে।’
‘সারভাইভিং ৭১’ নামকরণ কেন? নির্মাতা বলছেন, একটা যুদ্ধ আসলে খুব ভয়াবহ একটি ব্যাপার। যারা এর মধ্য দিয়ে যায় তারাই একমাত্র বুঝতে পারে। যুদ্ধে আমরা আসলে বেঁচে থাকার লড়াই করি। এই সিনেমায় সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই এমন নামকরণ। গল্পের প্লটে বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রণ আছে। বাস্তব অংশটুকু নেওয়া হয়েছে নির্মাতার বাবা অধ্যাপক মোহাম্মদ রেজাউল করিমের নিজের যুদ্ধকালীন ঘটনাবলি থেকে। এ ছাড়া অন্যান্য অংশটুকুও বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। সিনেমাটির দৈর্ঘ্যে ১৫ মিনিটের মতো হবে। ভবিষ্যতে ফিচার লেন্থ বা মিনি সিরিজ হতে পারে। ভিজ্যুয়াল ট্রেইলারে যেমন প্রকাশ করা হয়েছে, কাঠামোটা তেমনি থাকবে।
সিনেমাটির চরিত্র ও অভিনয়শিল্পী যাঁরা ‘সারভাইভিং ৭১’ সিনেমায় ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে আছেন জয়া আহসান, মেহের আফরোজ শাওন, তানযীর তুহিন, গাউসুল আলম শাওন, সামির আহসান, অনিক খান ও ওয়াহিদ ইবনে রেজা। এ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শর্টফিল্মের জন্য মেহের আফরোজ শাওনের ভয়েসটি রেকর্ড করা হয়েছে। বাকি সবার ভয়েস নেওয়ার কাজ চলছে। এ ছাড়া টিজারে অতিথি ভয়েস শিল্পী হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আরিফ আর হোসেন, সাদাত হোসাইন এবং কাজী পিয়াল। এতে অতিথি ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে থাকবেন আরো অনেকেই।
মূল চরিত্র চলচ্চিত্রটিতে তিনটি মূল চরিত্র, যাঁদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের তিনটি দিক দেখানো হবে। ওয়াহিদ বলছেন, যুদ্ধের সিনেমায় আসলে আলাদা করে নায়ক-নায়িকা বলা মুশকিল। চরিত্রের বিস্তারিত মুক্তির পর জানা যাবে।
যেভাবে তৈরি হচ্ছে ‘সারভাইভিং ৭১’ সিনেমাটির চিত্রনাট্য শেষ হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ২০১৮ চলে গেছে প্রি-প্রডাকশন, কনসেপ্ট ইত্যাদিতে। টিজার ট্রেইলারের এনিমেশনের কাজ শুরু হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
প্রথমে তৈরি হয় কনসেপ্ট। চরিত্র, প্রপোস থেকে শুরু করে নানা রকমের ডিজাইন। তারপর স্টোরিবোর্ড। এনিমেশনের ফিল্ম বানানোর এই ধাপটাকে বলে প্রি-প্রডাকশন।
ওয়াহিদ বলছেন, ‘যেহেতু এ রকম একটা প্রজেক্টে বেশ সময় দিতে হয় এবং অনেকের অনেক রকম ব্যস্ততা ছিল, দল থেকে সরে গেছেন বেশ কয়েকজন। থেকে গেলেন প্রডাকশন ডিজাইনার শরিফুল ইসলাম তামিম আর কনসেপ্ট আর্টিস্ট নাভিদ এফ রাহমান। আমরা তিনজন মিলেই কাজ শুরু করলাম প্রাথমিক ডিজাইনের।
প্রথমে নির্ধারণ করতে হয় কী রকম হয় এনিমেশনের স্টাইলটি। রঙের প্যালেট কী রকম হবে, ব্যাকগ্রাউন্ড কী রকম হবে ইত্যাদি খুব ডিটেইলভাবে শেয়ার করলাম তামিমের সঙ্গে। আমাদের লক্ষ্য ছিল আমরা প্রথমে দেড় মিনিটের একটা ফার্স্ট লুক টিজার বানাব, যা দেখে দর্শক সিনেমার ধরন, এনিমেশনের ধরন ইত্যাদি বুঝতে পারবে। আর সেটা দেখিয়ে চলচ্চিত্রটির ১৫ মিনিটের জন্য ফান্ডিং চাইতে পারব।’
সে হিসেবেই কাজ শুরু করেন ওয়াহিদ। তিনি বলেন, ‘ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য রেফারেন্স হিসেবে দেখলাম বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপের ছবি, যা থেকে রঙের প্যালেটেরও একটা ভালো ধারণা পাওয়া গেল। চরিত্রের ডিজাইন করতে গিয়ে পড়লাম মুশকিলে। কেন যেন কিছুতেই হচ্ছিল না। চুল, চোখ, পোশাক-আশাকের ধরন মিল ছিল না একেবারে। আমরা তখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখা শুরু করলাম। এনিমেশন ছবিতে কনসেপ্ট কিন্তু আঁকা হয় বাস্তব মডেলের ওপর ভিত্তি করে। ঠিক করলাম আমরাও সেটাই করব। এতে এক ধরনের শ্রদ্ধাও জানানো যাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই টিজারের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজাইনটা সহজ হয়ে গেল। আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, যানবাহন ইত্যাদির সূত্রও গ্রহণ করলাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি থেকে। আর পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সম্পূর্ণ অন্য রকমভাবে চিন্তা করলাম। ডিজাইনের পুরো কাজটা একাই করলেন তামিম। কানাডার টরন্টোয় বসে লোগো ও থিমেটিক পোস্টার করেন নাভিদ। এরপর কাজ শুরু হলো স্টোরিবোর্ডের। দৃশ্য ধরে ধরে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে দিলেন ওয়াহিদ। সেটা অনুযায়ী প্রথমে রাফ স্কেচ এবং পরে ফাইনাল স্কেচ করলেন তামিম। একই সঙ্গে করে ফেললেন ব্যাকগ্রাউন্ড ও এনিমেটিকের কাজ। আর এরই সঙ্গে শেষ হলো ছবির প্রি-প্রডাকশনের ধাপ। এরপর প্রডাকশন! সাউন্ড ও মিউজিকে প্রথমে কিছু রাফ ট্র্যাক করে সাহায্য করলেন তনয়। পরে সাউন্ড ডিজাইনার হিসেবে দলে যোগ দিলেন রাজেশ সাহা এবং রিপন নাথের স্টুডিও ‘সাউন্ডবক্স’। অনেক কষ্ট করে, ক্ষেত্রবিশেষে ভয়েস আর্টিস্টদের বাসায় বা অফিসে গিয়েও রেকর্ড করে এলেন রাজেশ। খুব চমৎকার সাউন্ড ডিজাইনের কাজও করলেন তিনি। এদিকে পাশাপাশি মিউজিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেন মেঘ দলের গিটারবাদক ও স্টুুডিও ‘কাউবেল’-এর কর্ণধার শোয়েব। একটা মিউজিক বা আবহ সংগীতও দেখতে দেখতে তৈরি হলো। এদিকে ততক্ষণে এনিমেশন টেস্ট শুরু হয়ে গেছে। কাজটি করছে মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন আরিফ। অনেক পরিশ্রম করলেন তিনি ও তাঁর দল। মুরাদকে নিয়ে সাইকোর স্টুডিওতে নিজের থ্রিডি দল নিয়ে একটা ট্রেনের মডেল তৈরি করলেন। করলেন টুডি পরীক্ষাও। কিন্তু প্রায় বেশ কয়েক মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যেটা বোঝা গেল, যে রকম এনিমেশন তাঁরা বানাতে চাইছেন, তা বাংলাদেশে করতে গেলে অনেক সময় দিতে হবে। এদিকে তত দিনে এক বছরের বেশি সময় চলে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে টিজার শেষ করার কথা! যখন ওয়াহিদ বুঝতে পারলেন বাংলাদেশে এনিমেশনের অংশটুকু করতে পারবেন না, তখন যোগাযোগ করলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট এনিমেশন স্টুডিওর সঙ্গে। অবশেষে কানাডার হ্যালিফ্যাক্সের একটি এনিমেশন স্ট্রডিও-স্টেলার বোর যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে কাজ করতে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলো এনিমেশনের পুরোদস্তুর কাজ। অবশেষে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ইউটিউবে প্রকাশিত হয় এনিমেশনটির দেড় মিনিটের টিজার। ভালো সাড়াও মেলে। লাখের বেশি ভিউ হয়েছে সেটির।
মুক্তি পাবে কবে? করোনার হানায় পিছিয়ে গেছে এনিমেশনটির মুক্তি। তবে ছবি তৈরির তহবিল জোগাড় হয়েছে, কাজের পরিবেশ ফিরলে দ্রুতই তা শেষ করতে চান নির্মাতা। ২০২১ সালের মধ্যে এটির মুক্তির আশা করছেন তাঁরা।