১২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আশার দিন ফুরাচ্ছে না
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই কলেজসহ সারাদেশের মোট ৩০২টি বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির কথা জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পত্র দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পর নানা প্রক্রিয়া করতেই পার হয় প্রায় দুই বছর। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এসব কলেজ সরকারীকরণ করা হয়। ১২ আগস্ট আদেশ জারি হলেও তা ওই বছরের ৮ আগস্ট থেকে কার্যকর ধরা হয়। সরকারীকরণের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে মূল্যবান আরো দুটি বছর। অথচ আজও এসব কলেজের সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি হতে পারেননি। কাগজপত্র দফায় দফায় যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে শিক্ষকদের অভিযোগ। খবর: সমকাল
৩০২টি কলেজের মধ্যে গত চার বছরে মাত্র তিনটি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি হতে পেরেছেন। বাকি ২৯৯টি কলেজের জনবল সরকারীকরণের কাগজপত্র যাচাই চলছে। কয়েক দফায় এসব কাগজপত্র যাচাই করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। যাচাই শেষ করে সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয় মাউশি। এখন আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেগুলো যাচাই করছে। মাউশির একই কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের যাচাই কাজেও অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষকদের মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে। আর এ কাজে তাদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে মাউশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
শিক্ষকদের অভিযোগ, জাতীয়করণের কাজে অহেতুক কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করা হচ্ছে। যেসব নথি শিক্ষকদের কাছে থাকার কথা নয়, সেগুলোও তাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে। নিজ হাতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খালি হাতে বিদায় নিচ্ছেন কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। সরকারীকরণের দুই বছরের অধিক সময় পার হলেও শিক্ষার্থীরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো কলেজ কর্তৃপক্ষ নন-এমপিও শিক্ষকদের কলেজ অংশের বেতন-ভাতা চালু রাখলেও করোনাকালে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বহু কলেজ। যার ফলে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষকরা। সরকারীকরণ তাদের জন্য যেন এক মরণফাঁদ। একই কলেজে একই সঙ্গে চাকরি করে কেউ মাস শেষে বেতন পাচ্ছেন, আবার কেউ বিনা বেতনে কাজ করছেন। ঘর ভাড়া, যাতায়াতসহ সব খরচ শিক্ষকদের নিজেদের বহন করতে হচ্ছে। অথচ সরকারীকরণের আগে কলেজ থেকে তারা বেতন পেতেন। শিক্ষকদের মতে, একসঙ্গে সরকারি হওয়া কলেজগুলোর মধ্যে অন্তত ৪৭ শতাংশ কলেজ শিক্ষকদের বেতন বন্ধ রয়েছে।
সরকারি কাউখালী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শেখ নজরুল ইসলাম জানান, সরকারীকরণ কাজের ধীরগতির ফলে কলেজগুলোতে দিন দিন শিক্ষকের পদ শূন্য হচ্ছে। তার কলেজে ১২ জন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার ফলে কয়েকটি বিষয়ের শিক্ষক নেই। তীব্র শিক্ষক সংকটে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। একাধিক শিক্ষক জানান, কলেজ সরকারি হওয়ার পর বেসরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়াও যাচ্ছে না। অথচ এরই মধ্যে অনেকে অবসরে চলে যাওয়ায় পদ শূন্য হয়ে গেছে। শিক্ষক সংকটে রুটিনমাফিক ক্লাস চালিয়ে নেওয়াই দায়। বাধ্য হয়ে এক বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে অন্য বিষয়ের ক্লাস চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কলেজ সরকারি হয়ে গেলেও এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও মর্যাদা পাচ্ছেন। অন্যদিকে, এসব কলেজের দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে মাসে মাসে বেসরকারি কলেজের বেতন, টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে তাদের শিক্ষা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি কলেজের বেতন মাত্র ২৫ টাকা। শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি থাকায় ছাত্রদের দেওয়া বেতন, ফি ও সরকারি এমপিওভুক্তির অর্থ থেকে এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এখন পরিশোধ করা হচ্ছে। সরকারি হতে না পারায় এই শিক্ষক-কর্মচারীদের সবার হৃদয়ে এখন ভর করেছে তীব্র হতাশা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুসারে, এসব কলেজে ডিগ্রি থাকলে প্রতিটি বিষয়ে তিনজন, অনার্স থাকলে কমপক্ষে সাতজন এবং মাস্টার্স থাকলে কমপক্ষে ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কর্মচারী থাকবে। অথচ সরকারি হওয়ার পর দুই বছরে এসব কলেজের অন্তত পাঁচ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে চলে গেছেন। খোঁজ নিয়ে এমনও দেখা গেছে, একটি বিভাগে (বিষয়ে) একজন মাত্র শিক্ষক অনার্স স্তরে পড়াচ্ছেন। এতে কলেজগুলোর একাডেমিক কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুসারে, সরকারি কলেজবিহীন প্রতি উপজেলায় একটি বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণের আওতায় সরকারের গত মেয়াদে মোট ৩২৪টি কলেজ সরকারীকরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট একই দিনে এক আদেশে ২৯৯টি কলেজ সরকারি হয়। এই কলেজগুলোতে সরকারিভাবে শিক্ষক-কর্মচারীর পদ সৃষ্টি না হওয়ায় কর্মরতরা কেউ সরকারি চাকরিতে আত্তীকরণ হতে পারেননি। জানা গেছে, এসব কলেজের শিক্ষকের মর্যাদা এবং বদলি ও পদোন্নতি কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। পরে `আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮` নামে নতুন বিধি প্রণয়ন করে এই ২৯৯টি কলেজ সরকারি করা হয়। ৩২৪টি কলেজের বাকি কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা `আত্তীকরণ বিধিমালা-২০০০` অনুসারে সরকারি হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে পদ সৃষ্টির জটিলতা তৈরি হয়নি।
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, এসব কলেজের শিক্ষকরা সরকারি হওয়ার পর পিএসসির অধীনে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডারভুক্ত হতে পারবেন। আবার নন-ক্যাডার হিসেবেও থাকতে পারবেন।
শিক্ষকরা জানান, মাউশির বিভিন্ন টেবিলে বসে এই জাতীয়করণবিরোধী মনোভাবের কর্মকর্তারাই তাদের কাগজপত্র যাচাই করেছেন। তারা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের নামের পাশে অযাচিত মন্তব্যের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। কাগজ যাচাইয়ের সময় `শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ড গঠনে ত্রুটি আছে, নিবন্ধন পরে কেন, রেজুলেশনে ভিন্ন হাতের লেখা কেন, নম্বরপত্রে নিয়োগকারী সিল অস্পষ্ট কেন, ডিজির চিঠি নেই কেন, অধিভুক্তির আগে বা পরে নিয়োগ কেন`- ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের বিব্রত করেছেন। একই কাজ তারা এখন মন্ত্রণালয়ে বসে করছেন। একাধিক শিক্ষক বলেন, তিনি তার কলেজের নিয়োগ বোর্ডে প্রার্থী ছিলেন, চাকরি পেয়ে এতকাল চাকরি করেছেন। অথচ এখন তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে- নিয়োগকারী অধ্যক্ষের সিলমোহর অস্পষ্ট কেন? অথচ তিনি নিজে তো নিজেকে নিয়োগ দেননি। এতকাল পরে নিয়োগের কাগজে সিলমোহর অস্পষ্ট কিনা, তাও তার তো জানার কথা নয়। অথচ এসব প্রশ্ন তুলে এখন নিয়োগের কলামে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক গোলাম মোস্তফা ২০০৪ সালে নিয়োগ পান। মাউশি কাগজপত্র যাচাই শেষে তার নামের শেষে মন্তব্য কলামে লিখেছে- নিয়োগকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি যিনি থাকার কথা, তিনি না থেকে অন্য একজন ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে এই নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে এ নথি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আর পাঠানো হয়নি। যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি যার থাকার কথা, তিনিই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন।
মুলাদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার কলেজে কয়েকজন কর্মচারী ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা যথাসময়ে যথাযথভাবে নিয়োগ পেয়েছেন এবং যোগদান করেছেন বলেই পরবর্তী সময়ে সেসব কাগজপত্রের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত হতে পেরেছেন। এত দিন আগেকার তাদের নিয়োগ রেজুলেশন এবং নম্বরপত্র কলেজে এখন আর নেই। এত বছর পর নিয়োগকালীন নম্বরপত্র দিতে না পারার কারণে তাদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে যাচাইয়ের কাগজে। ঠুনকো এই কারণে তারা সরকারি হওয়া থেকে বঞ্চিত হলে তা খুবই দুঃখজনক হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, রাজশাহী জেলার একটি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের জন্য পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগকল্পে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সেই নিয়োগ পরীক্ষায় একজন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। কিছুদিন পর কলেজ থেকে অধ্যক্ষ তাকে নিয়োগপত্র দেন এবং সেই থেকে তিনি কলেজে কর্মরত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্তভাবে পদ সৃজনের নামের তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য পদ সৃজনের মিটিংয়ের পর জানা যায়, সেই শিক্ষকের নামের পাশে মন্তব্য লেখা আছে- তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছেন। যদিও কলেজে ওই শিক্ষকসহ পাঁচজন শিক্ষকই কর্মরত। এই শিক্ষক প্রশ্ন তুলে বলেন, কে চাকরিতে যোগদান করেছেন বা কে পদত্যাগ করেছেন- এ বিষয়ে তো আর আমার জানার কথা নয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভুলের কারণে আমি কেন আত্তীকরণ থেকে বঞ্চিত হবো?
নেত্রকোনার কলমাকান্দা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খাইরুল আনাম বলেন, মাউশি থেকে শিক্ষকদের নামের পাশে যে অযাচিত মন্তব্য দিয়ে শিক্ষকের পদ সৃজন ও অ্যাডহক নিয়োগের পথ রুদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে, এটা খুবই দুঃখজনক। প্রাতিষ্ঠানিক কারণে যেসব ত্রুটি ধরা হচ্ছে, তার দায় শিক্ষকের হতে পারে না। এর দায় মাউশি এড়াতে পারে না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক দেখভালের দায়িত্ব তাদেরই।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কলেজ শিক্ষক পরিষদের (বাসকশিপ) সভাপতি কে এম দেলোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক হোসেন বলেন, সরকারীকরণের জন্য সরেজমিন পরিদর্শনের তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে কর্মরত সব শিক্ষক-কর্মচারীর অ্যাডহক নিয়োগ দিতে হবে। পদ সৃজনের প্রস্তাবনায় শিক্ষক-কর্মচারীদের নামের পাশে অযাচিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাউশির কর্মকর্তারা যে নোট দিয়েছেন, তা পরিহার করা এবং নোট প্রদানকারী মাউশি কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত আত্তীকরণ কমিটিতে রাখা যাবে না। শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগকালীন প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটির দায় শিক্ষকদের ওপর চাপানো যাবে না। এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কলেজ অংশের বেতন-ভাতাদি চলমান রাখা এবং তা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দিতে তারা সরকারের প্রতি দাবি জানান। তারা বলেন, সরকারি ঘোষণার তারিখে বয়স ৫৯ বছর ছিল, এমন শিক্ষক-কর্মচারীদের ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দিতে হবে।