সীতাকুণ্ডে অস্ত্রহীন আনসার, কারখানায় বেড়েছে হামলা-লুট
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কারখানাগুলোতে দুর্বৃত্তদের হামলা ও লুটের ঘটনা বেড়ে গেছে। গত এক মাসে প্রায় ১০টি কারখানায় হামলার ঘটনায় ওই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। অন্যদিকে উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টেও দিনে-দুপুরে লুটের ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি লুটপাট হচ্ছে ছলিমপুর, বাইপাস সড়ক, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারী, বানুর বাজার, জলিল রেলগেট ও ফুয়েল প্লাস পেট্রল পাম্প এলাকায়। আনসার সদস্যদের দাবি, তাদের হাতে অস্ত্র না থাকায় দুর্বৃত্তরা কারখানায় হামলা চালাতে ভয় পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা স্ক্র্যাপ লোহা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লরি করে বিভিন্ন রি-রোলিং মিলে নেওয়ার সময় গণহারে লুটের ঘটনা ঘটছে।
গত ৩ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) গভীর রাতে উপজেলার বাড়বকুণ্ড এলাকায় পরিত্যক্ত রাষ্ট্রীয় কেমিক্যাল উৎপাদন প্রতিষ্ঠান চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স (সিসিসি) কারখানায় একদল দুর্বৃত্ত একনলা বন্দুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে দুই আনসার সদস্য আহত হন। তারা বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কারখানায় কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, কারখানাটির ভেতরে তাদের ক্যাম্প রয়েছে। ক্যাম্পে ২৫ জন কর্মরত। তারা পালা করে কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে শতাধিক দুর্বৃত্ত কারখানার ভেতরে ঢুকে লোহার যন্ত্রপাতি লুট করতে শুরু করে। আনসার সদস্যরা বাধা দিলে অন্তত আটজনকে বেঁধে মারধর করা হয়। এ সময় দুজন আনসার সদস্য রক্তাক্ত হন। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের দুটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযান চালিয়ে আনসার সদস্যদের উদ্ধার করে।
আনসার সদস্যরা জানান, তাদের হাতে যখন অস্ত্র ছিল, ডাকাত-সন্ত্রাসীরা ভয় পেত। এখন আর ভয় পায় না। বরং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলে উল্টো হামলা করে। রাতের বেলায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু অস্ত্র থাকলে দুর্বৃত্তরা ভয়ে কাছে আসে না।
উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের চৌধুরীঘাটা এলাকায় এ কে এস স্টিল মিলের স্ক্র্যাপের ডিপোতে চারবার হামলা চালিয়ে লোহা, তামা ও পিতল লুট করে দুর্বৃত্তরা। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের মারধর করার ঘটনাও ঘটে।
কারখানাটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক ইমরুল কাদের ভূঁইয়া জানান, সীতাকুণ্ডে তাদের দুটি কারখানায় ১০০ আনসার সদস্য নিয়োজিত। এক মাস ধরে আনসার সদস্যদের অস্ত্র না থাকার বিষয়টি দুর্বৃত্তরা জেনে গেছে। ফলে তারা আনসারদের পাত্তা দিচ্ছে না। গত মাসে তাদের স্ক্র্যাপ ডিপো থেকে কয়েক দফা মালামাল লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। পরে তারা নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়ে লুট করা কিছু মালামাল উদ্ধার করেছেন।
জানতে চাইলে বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত খবরের কাগজকে বলেন, দুর্বৃত্তরা কাঁচামাল লুট করে নিয়ে যায়। অভিযোগ করছি। কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাচ্ছি। তবে এসব ঘটনা বন্ধ হওয়া দরকার। বিএসআরএমের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সুলাইমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘টহল বাড়িয়েছি। খবর পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা কমানোর চেষ্টা করছি। জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে, যেন কোথাও হামলার ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে পারে।’
চট্টগ্রাম জেলা আনসার কমান্ডার আবু সোলাইমান খবরের কাগজকে বলেন, গত ২৯ আগস্ট সারা দেশের আনসার সদস্যদের কাছ থেকে তাদের নামে বরাদ্দ করা অস্ত্র প্রত্যাহার করার পর থেকে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে। দুর্বৃত্তরা আনসার সদস্যদের নিরস্ত্র দায়িত্ব পালনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। লুট করে নিয়ে যাচ্ছে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার মালামাল। এসব দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হচ্ছেন দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। যতদিন আনসার সদস্যদের হাতে অস্ত্র ফেরত না আসবে, ততদিন কারখানাগুলো নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
তিনি বলেন, আনসার সদস্যদের হাতে অস্ত্র ফেরত দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলে গুরুত্ব অনুসারে আনসারদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। সিসিসি কারখানায় হামলার ঘটনায় মালিকপক্ষ মামলা করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ সাত দিন পেরিয়ে গেলেও থানায় কোনো অভিযোগ দেয়নি।
এদিকে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) আমদানীকৃত স্ক্র্যাপ পরিবহনের নিরাপত্তাকাজে নিয়োজিত সদস্যদের ওপর হামলার প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদনও করেছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি আবু তাহের।
উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা আনসার কমান্ডার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাগর উপকূলে জাহাজভাঙা (শিপ ব্রেকিং) কারখানা ছাড়াও সীতাকুণ্ডে মোট ১৬০টি ছোট-বড় কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি কারখানায় ৬০০ জন আনসার সদস্য কর্মরত।
বারো আউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোকন চন্দ্র নাথ খবরের কাগজকে বলেন, মহাসড়কে ২৪ ঘণ্টা টহল পুলিশ থাকে। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর পরই কিছু ঘটনা ঘটেছে। এখন ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মজিবুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে দুর্বৃত্তদের হামলার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বরত আনসার কেউ এখন পর্যন্ত সীতাকুণ্ড থানায় মামলাও করেননি।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, অস্ত্র ছাড়া আনসার বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলে দুর্বৃত্তদের সামনে তাদের মনোবল থাকবে না। এর ফলে তাদের হাতে অস্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।