ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪
আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ০৯:৩৯

ব্যাংকে নারীর ২৫ বছরের সঞ্চয় ‘উধাও’

অনলাইন ডেস্ক
ব্যাংকে নারীর ২৫ বছরের সঞ্চয় ‘উধাও’

অল্প অল্প করে সঞ্চয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন সাবেক পোশাক শ্রমিক মাহমুদা নাছরিন। বহু কষ্টের টাকায় ভবিষ্যতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের আশা ছিল। কিন্তু ২৫ বছর ধরে ব্যাংকে জমানো টাকা একজন তুলে নিয়ে গেছেন।

ঘটনাটি ঘটেছে বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের সাভারের ডিইপিজেড শাখায়।

টাকার পরিমাণ দুই লাখ। মাহমুদার কাছে এই অংক বিশাল। ১০ বছর পোশাক কারখানায় চাকরি জীবনের যা কিছু উদ্বৃত্ত, সবজি বিক্রি করে পাওয়া টাকা, আর শখ আহ্লাদের জন্য স্বামীর দেয়া টাকা খরচ না করে রেখেছিলেন ব্যাংকটিতে।

গত মাসে চেকবই খুঁজে না পেয়ে ব্যাংকে যান মাহমুদা। গিয়ে দেখেন তার হিসাব থেকে দুই লাখ টাকা নাই হয়ে গেছে।

জানতে পারেন, ‘আকাশ’ নামে এক ব্যক্তি তার টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। তবে তিনি তাকে চেনেন না, কোনো চেকও দেননি।

এই ঘটনায় মাহমুদা আশুলিয়া থানায় চেক জালিয়াতির অভিযোগ এনেছেন।

মাহমুদা বলছেন, গ্রাহক নিজে উপস্থিত না থাকলে ৩০ হাজার টাকা তুললেও ব্যাংক থেকে ফোন করা হয়। আর দুই লাখ টাকা তুললে যে টাকা আনতে গিয়েছেন, তার জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। কিন্তু প্রাইম ব্যাংক তার কিছুই করেনি।

তিনি জানান, ব্যাংকের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের কাছে এসব নিয়ে জবাব জানতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে কিছু না বলে ‘কটূকথা’ বলা হয়েছে। টাকা হারানোর শোকের পর অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।

২৮ অক্টোবর আশুলিয়া থানায় করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, গত ১১ অক্টোবর বাসায় চেক বই খুঁজে না পেয়ে দ্রুত ব্যাংকে যান মাহমুদা। সেখানে গিয়ে সব জানতে পারেন তিনি।

অনেক কষ্টের সঞ্চয়

মাহমুদা নাছরিন ১০ বছর চাকরি করেছেন পোশাক কারখানায়। স্বামী পেশায় গাড়ি চালক। প্রায় ২৫ বছরের সংসার। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে যখন যেমন পেরেছেন, টাকা জমিয়েছেন মাহমুদা।

নিউজবাংলাকে এই নারী বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে ১৪ বছর বয়সেই মা-বাপ বিয়া দিয়া ফালায়। ১৯৯৬ সালে দেশের বাড়ি টাঙ্গাইল থাইকা ঢাকায় চইলা আসি। স্বামী রেজাউল করিমও আমার লগেই আসে। আমি চাকরি নেই ইপিজেডের গার্মেন্টসে। আর স্বামী ছোট্ট একটা কসমেটিকসের দোকান দ্যায়। তখন থাইকা আমি অনেক কষ্ট করছি।

‘শ্রীপুর খান কলোনি থাইক্কা ৪০-৪৫ মিনিটের পথ হাইট্যা গার্মেন্টসে গেছি। গাড়ি ভাড়ার ৫-৬ টাকা বাঁচাইছি। অফিসে দুপুরের টিফিন না খাইয়া সেই ট্যাকাও রাখছি। অফিসের ইনক্রিমেন্ট আর ওভারটাইমের কিছু টাকাও জমাইছি। স্বামী শখ কইরা কিছু কিনতে দিলে হেইডাও কিনি নাই।

‘মাসে ২০০-৫০০ টাকা স্বামীরে না জানাইয়া গোপনে পোস্ট অফিসে রাখছি। চাকরি করার সময়ই দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা হই। ছেলে-মেয়ের দেখাশুনা কইরা চাকরি করা কষ্ট হইয়া যাইতেছিল। এ কারণে ১০ বছর পর চাকরি ছাইড়া দেই।

‘২০১২ সালে পোস্ট অফিস থাইক্কা জমানো ৫০ হাজার টাকা তুইলা দ্যাশে মায়ের কাছে পাঠাই। টাঙ্গাইলেই মা কিছু জমি বর্গা নিয়া চাষ করতো। ছাগল কিন্যা দিছিলাম সেগুলা মা পালতো। চাকরি ছাড়ার পর কখনও বইসা থাকি নাই। বাড়ির পাশে মাইনসের পতিত জমিতে কুবাইয়া তরকারি লাগাইতাম। আবার সেই তরকারি বেঁচছি, দর্জির কাম করছি। হেই টাকা মাসে মাসে নিজের কাছে জমায় রাখছি।’

‘তিন-চার বছর আগে একজনের পরামর্শে প্রাইম ব্যাংকে একাউন্ট খুলছি। তখন কিছু টাকা রাখছিলাম। বছরে ৮০ হাজার, ৫০ হাজার, ২০ হাজার, ১০ হাজার ট্যাকাও রাখছি। এছাড়া যখন কিছু ট্যাকা জমত তখনই ব্যাংকে রাখতাম। এ্যামনে কইরা সাড়ে তিন লাখ টাকা আমার একাউন্টে জমা অয়।’

ব্যাংকে অপমানের অভিযোগ

মাহমুদা জানান, তিনি ব্যাংকে গিয়ে এ নিয়ে যখন জবাব চান, তখন অ্যাকাউন্টস অফিসার তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, ‘গত ১১ অক্টোবর বাসায় রাখা চেকবইটা খুঁইজ্যা না পাইয়া ব্যাংকে যাই। জানতে পারি আকাশ নামে একজন দুই লাখ ট্যাকা তার চেক দিয়া তুইল্যা নিয়া গেছে।

‘অফিসার শাহিনকে বলি, আমি তো কাউকে চেক দেই নাই। আর আকাশ নামে কাউকে চিনি না। এতগুলা টাকা দিলেন আমারে ফোনও দিলেন না? ভোটার আইডি কার্ডও রাখেন নাই?’

মাহমুদা জানান, তার কথা শুনে দুই অফিসার তার সঙ্গে যাচ্ছেতাই কথা বলেন।

‘আমারে পাগল সাব্যস্ত করে। যে নামে টাকা তুইলা নিয়া গেছে আমারে সে চেকটাও দেখাতে চায় নাই। তারা বলেন, আমি চেক দিছি তাই তারা টাকা দিয়া দিছেন। এখানে তাদের কিছুই করার নাই। পরে ম্যানেজারের কাছে গিয়া ওই চেকের ছবি তুইলা আনি।’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল যান মাহমুদা। সেখানে পানিতে ডুবে মারা যায় ১১ আর নয় বছরের দুই সন্তান।

মাহমুদা জানান, ছেলে-মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে, ‘মাথা ঠিক নাই’ বলে ব্যাংক থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বলিভদ্র শাখার প্রাইম ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ শাহতাব রিজভী ফোনে কথা বলতে রাজি হননি।

আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, ‘বিষয়টি সেনসিটিভ। তাই অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে ‘ব্যস্ততার কারণে’ তদন্তে যেতে পারেননি বলে জানান আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক জসিম।

 

 

উপরে