ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪
আপডেট : ১১ অক্টোবর, ২০২০ ১৫:৫৭

প্রতারক নাসিম যেভাবে হাতিয়ে নেয় ৩০০ কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক
প্রতারক নাসিম যেভাবে হাতিয়ে নেয় ৩০০ কোটি টাকা

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: আবুল হোসেন। ছোট্ট একটি চাকরি করেন। থাকেন মিরপুরে। ইটপাথরের এই শহরে দীর্ঘদিন থাকলেও নিজের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট কিছুই নেই। একসঙ্গে মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনারও সামর্থ্য নেই তার। তাই নিজের একটি স্থায়ী ঠিকানার জন্য দ্বারস্থ হন নাসিম রিয়েল এস্টেটে। ২০১৪ সালে দেড় লাখ টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে একটি প্লটের জন্য চুক্তি করেন। পরে প্রতি তিন মাস পর পর ১৫ হাজার টাকা কিস্তি। এভাবে গত চার বছরে তিনি টাকা দিয়েছেন ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

শুধু তিনিই নন। তার দূর সর্ম্পকের ভাইয়ের ছেলে ব্যবসায়ী কনক। পাঁচটি প্লটের জন্য দিয়েছেন ৩৭ লাখ টাকা। তার আরেক ভাইয়ের ছেলে তারই মতো দিয়েছেন ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। আবুল হোসেন বলেন, সাভারের উত্তর কাউন্দিয়া এলাকায় পানির উপর ভুয়া সাইনবোর্ড দেখে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু টাকা দেয়ার পর, একটি পর্যায়ে আর যোগাযোগ করতে পারিনি ওই কোম্পানির কারো সঙ্গে। যদিও যাদের মাধ্যমে আমরা টাকাগুলো দিয়েছি তারা বলছিল, তাদের কিছু করার নেই। তারা চাকরি করেন। আবুল হোসেনর মতো আরেকজন বকুল চন্দ্র দাস। শিক্ষকতা করেন। ২০০৭ সালের দিকে তিনি ও তার স্ত্রী বাসায় টিউশনি পড়িয়ে টাকা জমাতেন। ইচ্ছা নিজের টাকায় একটি প্লট। একদিন জানতে পারলেন, সাভারের কাউন্দিয়ায় স্বল্পমূল্যে জমি বিক্রি হচ্ছে। তা-ও আবার খুব অল্প টাকার কিস্তিতে। পরে তারা নাসিম রিয়েল এস্টেটের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দু’টি পাঁচ কাঠার প্লট মাত্র তিন লাখ টাকায় কিনবেন বলে চুক্তি করলেন। কথামতো তিনি ১০০ কিস্তিতে ১০ বছরে তিন লাখ ৩৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন, কিন্তু টাকা পরিশোধের পর বুঝতে পারেন নাসিম রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া। পরে তার কাছে মাটি ভরাট বাবদ আরো দেড় লাখ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও তা তিনি দেয়া বন্ধ করে দেন। বকুল চন্দ্র বলেন, এসব দুই নম্বরি বোঝার পর তাদের কাছে টাকা চাইতে গেলে তারা আমাকে উল্টো নোটিশ দিয়ে ওই জায়গা ভরাট ও বিক্রি হওয়ার পর আমাকে টাকা ফেরত দেবে বলে জানায়। কবে দিবে কিছুই বলেনি। তখনই বুঝতে পেরেছি বিষয়টি পুরোটাই প্রতারণা। খুব কষ্ট পেয়েছি। তিল তিল করে জমানো টাকা এভাবেই দিয়ে দিলাম! এসব ভুক্তভোগীর মতো শত শত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম।   আবাসিক শহর গড়ে দেয়ার নামে প্রায় পাঁচ হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে বায়না করে প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং ২৫০ জনের সঙ্গে ভুয়া চুক্তিপত্র করা ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়ে ১২ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এই নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক নাসিম। এর বাইরে নাসিম ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাসিম নিজেকে পরিচয় দিতেন নাসিম গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক হিসেবে। যেখানে তিনি ১৬ টি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিতেন। এসব প্রতারণা করেও তার চলনে-বলনে ছিল বিশাল বহর।

অভিযোগ রয়েছে, সাভারের উত্তর কাউন্দিয়া এলাকায় পানির উপর ভুয়া সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ২০০৬ সাল থেকেই এসব প্রতারণা করে আসছিলেন নাসিম। পানির মাঝে একটি সাইনবোর্ড দেখে শুধু বিশ্বাসের উপরেই ভুক্তভোগীরা তার সঙ্গে চুক্তি ও প্রতিমাসে প্লট কেনার টাকা দিয়েছেন। আর এভাবেই নাসিম হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতারক নাসিম মূলত ২০০৭ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে প্লট বিক্রির নামে প্রতারণা শুরু করেন। সাভারের কাউন্দিয়ায় নদীর ওপারে পানির উপরে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চলত প্রতারণা। এজন্য ছিল তার বিশাল নিরাপত্তাবহর ও কর্মীবাহিনী। শুধু বিশ্বাসের উপরই ভুক্তভোগীরা নাসিমকে চুক্তি ও কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করেন।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা বলছেন, নানা অভিযোগে দায়ের করা ৫৫টি মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। প্রত্যেকটিই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে সব মিলেয়ে রয়েছে শতাধিক মামলা। গ্রেপ্তার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে গোপন সুড়ঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংবলিত দরজাযুক্ত অফিসে আত্মগোপনে থাকতেন নাসিম।

জানা গেছে, ইমাম হোসেন নাসিমের বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান থানার মেদুয়া গ্রামে। নাসিম ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঠিকাদারি পেশায় জড়িত ছিলেন। পরে ২০০২ সাল থেকে ‘নাসিম রিয়েল এস্টেট’ কোম্পানিটি তিনি শুরু করেন।

ভুক্তভোগী বিষ্ণু কুমার নামে একজন বলেন, অন্যদের মতো তাকেও সাড়ে চার কাঠা জমির জন্য ১৫ লাখ টাকা দেয়ার জন্য চুক্তি করে নাসিম। কথামতো তিনিও ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নাসিমকে ৮ লাখ টাকার উপরে পরিশোধ করেন। কিন্তু তিনি জমি পাননি। বিষ্ণু বলেন, যখন বুঝতে পারলাম আমি প্রতারিত হতে যাচ্ছি, তখন কিস্তি বন্ধ করে দিয়ে টাকা তোলার জন্য ধরনা দিতে থাকি। কিন্তু তিনি আমাকে ঘোরাতে থাকেন। আবার আমাদের সমিতির নামে ৮৬ শতক জমি কেনা বাবদ তাকে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। কিন্তু চাপে পড়ে তিনি মাত্র ৫৮ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। কিন্তু জমির কাগজপত্র নিয়ে আমি সন্দিহান। তার মতো আরেক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেখিয়ে জমি কিনতে উদ্বুদ্ধ করেন নাসিম। আসলে সেখানে তার মাত্র ১০ শতাংশের মতো জমি ছিল, যা তারা পরবর্তীতে জানতে পারেন। এমনকি টাকা পরিশোধের পর তার নাসিম রিয়েল এস্টেটের নামে বসানো সাইনবোর্ড হাওয়া হয়ে যায়।

মাদারীপুরের তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা এক প্রকার পানি দেখেই টাকা দিয়েছি। এটা আমাদের বড় ভুল ছিল। আমাদের আরো চারজন আত্মীয়স্বজন এখানে জায়গা রেখেছিল, তাই আমি আর যাচাই করতে যাইনি। আমাদের চারজন প্রায় ১৭ লাখ টাকা দিয়েছি। কিস্তি পরিশোধ করার পর ২০১৭ সালে তারা মাটি ভরাটের জন্য আমাদের কাছে আরো দেড় লাখ টাকা করে চাইতে থাকে। তখন বুঝেছি আমরা প্রতারণার ফাঁদে পড়েছি। এর আগে কখনোই বুঝতে পারিনি, কারণ আমাদেরকে তারা স্বচ্ছ রিসিট দিয়েছিল। এখন আমরা মামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এদিকে গত ১লা অক্টোবর মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে নাসিম রিয়েল এস্টেটের অফিসের আন্ডারগ্রাউন্ডে গোপন সুড়ঙ্গ থেকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার হয় ইমাম হোসেন। রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় নাসিমের বাসা ও চিড়িয়াখানা রোডে নাসিম রিয়েল এস্টেটের অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব-৪। নাসিমকে গ্রেপ্তারের পর একটি হটলাইন নম্বর চালু করে র‌্যাব। গত দশ দিনে এই হটলাইনে ও সরাসরি র‌্যাব’র অফিসে এসে চারশ’ জন প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ এনেছেন। র‌্যাব-৪ অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা মানি লন্ডারিং মামলা করার জন্য সিআইডিতে বিষয়টি পাঠিয়েছি। শাহ্‌ আলী থানায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়শেন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ‘নাসিম রিয়েলে এস্টেটের বিরুদ্ধে বছর চারেক আগে দু’টি অভিযোগ এসেছিল। তাদেরকে বসিয়ে সেটা আমরা সমাধান করে দিয়েছি। এরপর আর কোনো অভিযোগ আসেনি। সূত্র: মানবজমিন।

উপরে