আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে অপরাধী চক্র
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণ করে তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়াই চক্রটির মূল কাজ। বাহিনীর পোশাক পরে টার্গেট ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে সবকিছু কেড়ে নেয়া ছাড়াও ডাকাতি, ছিনতাই করে চক্রটি। এমন কাজে ঝামেলা হলে নৃশংসভাবে হত্যাও করা হয় টার্গেট ব্যক্তিকে। চট্টগ্রাম, বগুড়া এবং চাঁদপুরসহ কয়েকটি জেলায় একাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করে টাকা পয়সাসহ দামি মালামাল লুট করার কাজটি চালিয়ে এলেও চক্রটি এবার ঢাকায় এসে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বিশেষ করে রাজধানীতে চক্রটি এমন টার্গেট নিয়ে একাধিক অপারেশনও চালিয়েছে। এমনকি রাজধানী থেকে একটি বায়িং হাউজের কর্মকর্তাকে অপহরণ করে তাকে হত্যা করে। রাজধানীর মতিঝিল থেকে দি ফ্যাশন বায়িং হাউজের কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেনের নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করে ডিবির গুলশান বিভাগ। উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমানের তত্ত্বাবধায়নে চক্রটির ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে মিলেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। চক্রের কাছ থেকে ডাকাতি ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত র্যাবের দুটি জ্যাকেট, একটি হাতকড়া, একটি ওয়্যারলেস সেট, একটি পিস্তল, ম্যাগজিন সংযুক্ত ৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, গত ১৪ জুলাই র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় দি ফ্যাশন বায়িং হাউজের কর্মকর্তা ৪৬ বছর বয়সী মো. সুলতান হোসেনকে। এরপর থেকে তার খোঁজ না পেয়ে স্বজনরা তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। আবুল হোসনের কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধের কারণে পুলিশের পাশাপাশি ডিবির গুলশান বিভাগ সুলতান হোসেনের নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে ১৬ জুলাই অজ্ঞাত ব্যক্তি হিসেবে সুলতানের লাশ মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা হাসপাতালের অদূরে রাস্তার পাশে পায় পুলিশ। পরে স্বজনরা নিশ্চিত করে ওই লাশ সুলতানের। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলাও দায়ের হয়। সুলতানের লাশ উদ্ধারের পর ডিবি পুলিশ হত্যায় জড়িতদের ধরতে জোর তৎপরতা শুরু করে। তথ্যপ্রযুক্তির সহয়তা এবং সোর্সের মাধ্যমে খুনিদের শনাক্ত করার জন্য একাধিক টিমকে কাজে লাগানো হয়। ডিবি অনেকটা নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর হত্যা কোন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রই ঘটিয়েছে।
ডিসি মশিউর রহমান জানান, নানা তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে শরীয়তপুর থেকে এ চক্রের অন্যতম সদস্য ফরহাদ হোসেনকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়। ফরহাদ হোসেনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সুলতান হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার কথা বেরিয়ে আসে। এরপর ফরহাদ চক্রের মূল হোতা আকবর আলী, আমিনুল ইসলাম সবুজ, অপহরণের কাজে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স চালক সুমন, সাহারুল ইসলাম সাগরকে গ্রেফতার করে।
ডিবি পুলিশ জানায়, চক্রটির দলনেতা কাজী মো. আকবর আলীর বিরুদ্ধে ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ১১টির বেশি মামলা রয়েছে। এ চক্রের অন্য সদস্য আমিনুল ইসলাম সবুজ, সাহারুল ইসলাম সাগর এবং ড্রাইভার সুমনের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। চক্রটি সবচেয়ে বেশি অপরাধ করেছে চট্টগ্রাম এলাকায়। এরপর বগুড়া, চাঁদপুরসহ কয়েকটি জেলায়ও এরা এমন ডাকাতি, হত্যাসহ একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে। সম্প্রতি এরা রাজধানীকেন্দ্রীক সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন অপরাধে এরা পুলিশের হাতে একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছে। কিছুদিন জেলে থাকার পর আবার জামিনে বের হয়ে এসে একই ধরনের অপরাধ করত।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, গত ১৪ জুলাই মতিঝিলে আসে দি ফ্যাশন বায়িং হাউজের কর্মকর্তা মো. সুলতান হোসেন। সুলতান হোসেনের কাছে ডলার আছে ভেবেই তাকে অপহরণ করার পরিকল্পনা নেয় চক্রটি। মতিঝিল থেকে অনুসরণ করে মিরপুর পল্লবী এলাকা পর্যন্ত সুলতান হোসেনের পিছু নেয় চক্রটি। পরে র্যাব পরিচয় দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ফেলে সুলাতন হোসেনকে। কিন্তু গাড়ির মধ্যে সুলতার হোসেন শুরু করায় গামছা প্যাঁচিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই সুলতান হোসেনকে হত্যা করে চক্রের সদস্য ফরহাদ হোসেন। অন্যরা তার হাত পা মুখ চেপে ধরে। হত্যা নিশ্চিত করার পর সুলতান হোসেনকে তল্লাশি চালিয়ে লাশ বহন করে পল্লবী থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর এলাকায়। সিঙ্গাইর উপজেলা হাসপতালের অদূরে রাস্তার পাশে লাশটি ফেলে দেয় তারা।
গ্রেফতারকৃত চক্রটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর ভুয়া পরিচয়ের আড়ালে সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হুন্ডির ব্যবসায়ী, বেশি ডলার ভাঙায় কিংবা যারা মতিঝিলের ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন করে, এমন লোকদের টার্গেট করে। পরে তাদের অনুসরণ করে সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে র্যাব পরিচয়ে গাড়িতে উঠিয়ে হাত-পা বেঁধে মারধর করে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ অর্থসহ যাবতীয় মালামাল ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইকারীদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে অনেকে চিৎকার-শুরু করলে গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়। চক্রের সদস্য সাগর ও আমিনুল ইসলাম সুমন ব্যাংকপাড়ায় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঘোরাঘুরি করে। কার কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আছে এমন ব্যক্তি চিহ্নিত করে সেই তথ্য মূল হোতা আকবর আলীকে জানায়। আকবর আলী কিভাবে অপারেশন করা হবে তা ঠিকঠাক করে। অন্যদের কাজ থাকে সহযোগিতা করার জন্য।
যেভাবে সুলতানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়
ঘটনার বিবরণে ডিসি মশিউর জানান, গত ১৪ জুলাই সাগর ও সবুজ মতিঝিল মানি এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে সুলতানকে অনুসরণ করেন। পল্টন মোড় থেকে সুলতানের সঙ্গেই বিআরটিসি বাসে ওঠেন সাগর ও সবুজ। তারা চক্রের অপর সদস্য আকবরকে ফোন করে লোকেশন জানান। পূর্বপরিকল্পিতভাবে ছিনতাইয়ের কাজের জন্য ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স অনুসরণ করে বাসটি। ফার্মগেটে নেমে সুলতান মিরপুরগামী শিখর পরিবহনের বাসে উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে সাগর ও সবুজ তাকে অনুসরণ করে সেটিতে ওঠেন। তারা আকবরকে জানান, সুলতানের কাছে অনেক বিদেশি ডলার আছে, কাজটি করতে হবে। তখন আকবর অ্যাম্বুলেন্সযোগে পুনরায় বাসটিকে অনুসরণ করতে থাকেন।
পল্লবীর পূরবী সিনেমা হলের সামনে সুলতান নামার পরই আকবর, মনির, ফরহাদ নিজেদের র্যাবের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সুলতানকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠান। আকবরের হাতে ওয়্যারলেস সেট, মনিরের গায়ে র্যাবের পোশাক, ফরহাদের গায়ে র্যাবের পোশাক এবং হাতে একটি হাতকড়া ছিল। কিন্তু তারা র্যাবের প্রকৃত সদস্য নয় বুঝতে পেরে চিৎকার শুরু করেন সুলতান। মূল হোতা আকবর তখন সুলতানের হাতে থাকা ব্যাগটি তল্লাশি করতে থাকেন। কোন ডলার না পেয়ে তা কোথায় জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। ভয়ে সুলতান পুনরায় চিৎকার-চেঁচামেচি করলে অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে বসা মনির চালক সুমনের গামছা নিয়ে সুলতানের গলা প্যাঁচিয়ে ধরেন। পেছনের সিটে বসা আকবর তখন তার হাত চেপে ধরেন এবং ফরহাদ চেপে ধরেন পা। একপর্যায়ে চলন্ত পথেই মারা যান সুলতান।
মারা যাওয়ায় ছিনতাইকারী পুরো টিমসহ গাড়িটি গাবতলী-হেমায়েতপুর-সাভার হয়ে নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে সবাই নেমে পালিয়ে যান। ড্রাইভার সুমন একা লাশটি নিয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সিঙ্গাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে রাস্তার পাশে জঙ্গলে লাশটি ফেলে পালিয়ে যান। একদিন পর ১৬ জুলাই মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে মহাসড়কের ঢালে ঝোপঝাড়ের ভেতর একটি অজ্ঞাত পরিচয় মরদেহ পাওয়া যায়। পরে সুলতানের আত্মীয়স্বজন সেখানে গিয়ে তার মরদেহ শনাক্ত করেন। ওই ঘটনায় সুলতানের ভাই আবুল হোসেন বাদী হয়ে ১৮ জুলাই তেজগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি দায়ের হওয়ার পর থানা গোয়েন্দা পুলিশও ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে জড়িতদের গ্রেফতার করে।