ঢাবি ছাত্রী তুর্ণার প্রতারক হয়ে ওঠার গল্প
ক্লাসের শিক্ষকরা ক্যারিয়ার প্লানিং নিয়ে জানতে চাইলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার, শিক্ষক কিংবা ব্যাংকার হওয়ার কথা বলতো। কিন্তু একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি সব সময় বলতেন, পড়াশোনা শেষ করে উদ্যোক্তা হব, ব্যবসা করব। পড়াশোনা শেষ করে তার সহপাঠীরা যখন চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই তিনি ছোট্ট পরিসরে ব্যবসাও শুরু করেন।
গল্পটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রী রাহাত আরা খানম তুর্ণা ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিনের। বর্তমানে তার নিজের গড়া প্রোডাকশন ফ্যাক্টরিতে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। আর দুই-তিন বছর পরই সেটিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দাঁড় করানো স্বপ্ন ছিল তার। সে হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী তো বটেই, অনেক ছাত্রও তাকে আইডল ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই আইডল খ্যাতির চূড়ান্ত স্বীকৃতির পাওয়ার আগেই বাধ সাধল তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জড়িয়ে গেলেন বিদেশি একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার। তবে তুর্ণা কোন স্বপ্নই পূরণ হয়নি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী।
জানা যায়, দুই বছর আগে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন ওই ১১ নাইজেরিয়ান। এরপর তারা প্রতারণার জন্য নিয়োগ করেন রাহাত আরা খানম ওরফে তুর্ণাকে। পরবর্তীতে তুর্ণা নিজেই এই ব্যাবসায় পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। তথ্যমতে, ফেসবুকে প্রতারণার মাধ্যমে সারাদেশ থেকে ৫/৬ কোটি টাকা ঢুকেছে তুর্ণার অ্যাকাউন্টে। মূলত প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এই অভিযোগেই মঙ্গলবার রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে ১১ নাইজেরিয়ানসহ গ্রেপ্তার হন ওই ছাত্রী। বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম মঈনুল ইসলাম তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
জানা গেছে, তুর্ণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১১-২০১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএএফ শাহীন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। বাবা বিমান বাহিনীতে কাজ করার সুবাধে বেড়ে উঠেন চট্টগ্রামে। পরে তিনি অবসর গেলে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান।
এদিকে ঘটনা জানানানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তার সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র এবং শিক্ষকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটি কিভাবে এতবড় প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, অনেকেই তা বিশ্বাস করছেন না! তুর্ণার সহপাঠী ও সিনিয়র-জুনিয়ররা জানিয়েছেন, ২০১১-২০১২ সেশনে ভর্তি হওয়ার পর স্নাতক শেষ করে ২০১৫ সালে আর ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এরপর তিনি প্রাইভেট একটি আইটি ফার্মে জয়েন করেন। বছর খানেক পর ২০১৮ সালের শেষের দিকে তিনি ছোট্ট পরিসরে কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি চালু করেন। এর মধ্যেই খবর আসলো তিনি বিদেশি প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে কারাগারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার বিভাগের এক সহপাঠী জানান, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। এজন্য তিনি প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি চালু করেন। তার ভাষ্য, তুর্ণা যেকোনো উপায়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখত। এক্ষেত্রে কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তার কনফিডেন্সকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই তুর্ণার কার্যক্রম অস্বাভাবিক ছিল। তবে এ বিষয়ে ক্লাসের কারো সঙ্গে ওই অর্থে শেয়ারিং ছিল না।
আরেক সহপাঠী জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ে তার সাথে ক্যাম্পাসে প্রায় আড্ডা দিতাম। এর মাঝে সে নাইজেরিয়াও গেছে; যদিও এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে ‘ওপেন শেয়ারিং’ নেই। তার বক্তব্য, তুর্ণা সবসময় ফেসবুকে সরব থাকত। উদ্ধ্যত্বপূর্ণ পোশাকেও ছবি শেয়ার করত। সবকিছু মিলিয়েই সন্দেহ করলেও এতটা প্রতারণা করবে, সেটা ভাবিনি।
এদিকে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেশ পরিচিত ছিল তুর্ণা। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টকশোতেও বেশকয়েকবার অংশ নিয়েছেন। সখ্যতা ছিল সব মহলে। ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং অনেক সাংসদও ছিল তার এই সখ্যতার তালিকায়। নিজের ফেসবুকে সদ্য সাবেক ছাত্রলীগের দুই সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ও গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে ছবিও শেয়ার করেছেন তিনি।
তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক ছাত্রী জানান, তুর্ণা আপু বেশ চঞ্চল ও ডানপিঠে স্বভাবের ছিল। সিনিয়র-জুনিয়র সবার সাথে ভালো সর্ম্পক ছিল। এ কারণে উনার কথাবার্তা, চাল-চলনও আমি ফলো করতাম। কিন্তু এ ঘটনা (প্রতারণা) জানার পরত হতবাক। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!
ফাতিমা তাহসিন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ফেসবুকে লিখেছেন, তুর্ণা আহসান ফেসবুকে বেশ পরিচিত নাম। অনেক মেয়েই আবার তাকে তরুণদের আইডল হিসেবে মান্য করেন! সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টকশোতেও এটেন্ড করেছেন বহুবার! বহু নেতা, ছাত্রনেতা ও ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক আছে! এমপাওয়ারড নারী হিসেবে পরিচিত এই তূর্ণা আহসান আসলে একজন ভণ্ড যিনি স্বনির্ভরতার নামে ঠগবাজির ব্যবসা করেন!
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল হায়দার বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা ফেসবুকে বন্ধুত্বের নামে অনেক লোকের কাছ থেকে দামি উপহারের লোভ দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে রাহাত আরা খানম ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিন (২৭) নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন।
সূত্রের তথ্য, মূলত প্রতারণার শেষ ধাপে কাজ করতেন তুর্ণা। চক্রটি প্রথমে বিপরীত লিঙ্গের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করতেন। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে একটি ম্যাসেঞ্জার আইডি থেকে পার্সেল গিফট করার প্রস্তাব দেওয়া হত। পরে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমেই এই পার্সেল বুক করার এয়ারলাইন্স বুকিং ডকুমেন্টও পাঠাত প্রতারকরা।
এসব গিফট বক্সে বহুমূল্য সামগ্রী রয়েছে, এমনকি কখনো কখনো উপহারের বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানানো হয়। তারা ভুক্তভোগীকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কাস্টম গুদাম থেকে সেগুলো রিসিভ করতে বলেন। এরপরের কাজটিই করেন তুর্ণা। তিনি নিজেকে কাস্টমস কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের পার্সেল গ্রহণের শুল্ক পরিশোধের কথা বলতেন। টাকা না দিলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টির ভয়ও দেখাতেন ঢাবির এই প্রাক্তন ছাত্রী।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি জানান, আস্থা অর্জনের জন্য চক্রটি কোনও নগদ টাকা লেনদেন করে না এবং টাকা দেওয়ার জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করত। সর্বশেষ তুর্ণার দেয়া অ্যাকাউন্টে ভুক্তভোগী একজন তিন লাখ ৭৩ হাজার টাকা জমা দেন এবং তারপর থেকেই তুর্ণাসহ চক্রের সদস্যরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন এবং তখন তিনি থানায় অভিযোগ জানান।
‘এভাবে একজন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এরা গত দুই মাসে শতাধিক লোককে প্রতারণা করে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে,’ অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন।গ্রেপ্তার হওয়া নাইজেরিয়ানদের মধ্যে মাত্র তিন জনের পাসপোর্ট থাকলেও ভিসা নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘বাকিদের কাছে পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। আমরা তথ্য পেয়েছি যে তাদের আরও সহযোগী আছে। তাদের গ্রেপ্তারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’