ডিবিতে মুখোমুখি আরিফ-সাবরিনা
করোনা পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ওরফে সাবরিনা শারমিন হুসাইন ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ভার্চুয়াল আদালতে আরিফের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। পরে বিকেলে তাকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) মিন্টো রোড কার্যালয়ে। আরিফ ও সাবরিনাকে সেখানে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে মামলাটির তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, করোনা পরীক্ষার সনদ জালিয়াতি করা জোবেদা খাতুন সার্বজনীন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) ও ওভাল গ্রুপের সঙ্গে ডা. সাবরিনা নিজের সম্পৃক্ততা এখনো অস্বীকার করছেন। কিন্তু বিভিন্ন মানুষের মোবাইল ফোন নম্বরে তার পাঠানো বিভিন্ন খুদে বার্তা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এসব প্রশ্নের জবাবে সাবরিনা পুলিশকে বলেন, স্বামী আরিফ তাকে ফাঁসিয়েছেন। আরিফকে ডিবি কার্যালয়ে দেখেই ক্ষেপে ওঠেন সাবরিনা। বলেন, ‘তোর কারণে আজ আমার এই পরিণতি। আমি তোকে ছাড়ব না।’ তখন উপস্থিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে শান্ত করেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, পুলিশি জেরায় আরিফ সনদ জালিয়াতির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এজন্য তার প্রতিষ্ঠানের চাকরিচ্যুত কর্মচারী গ্রাফিকস ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু এবং তার স্ত্রী জেকেজির নার্স ও মাঠ সমন্বয়ক তানজীন পাটোয়ারীকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, নানা অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করার পর তারা ওয়েবসাইট খুলে ভুয়া সনদ দেওয়ার ব্যবসা শুরু করে। পরে নিজেরা বাঁচতে জেকেজির ওপর দোষ চাপিয়েছে।
তবে জেকেজি ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া করোনা সনদ দিয়ে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এই টাকার ভাগ নিয়ে আরিফ ও সাবরিনার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। সাবরিনাকে আরিফের দেওয়া সর্বশেষ ৫ লাখ টাকার চেক ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন সাবরিনার সঙ্গে বিরোধের এক পর্যায়ে আরিফকে লিগ্যাল নোটিসও পাঠান সাবরিনা। তাছাড়া আরিফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাবরিনা তড়িঘড়ি করে তালাকের নোটিস পাঠান। করোনা সনদ জালিয়াতি করে ৮ কোটি টাকা অবৈধ আয়ের বিষয়ে আলাদাভাবে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সাবরিনা ও আরিফের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের কাজ পাইয়ে দিতে যারা সহযোগিতা করেছেন তারা কেউ এখান থেকে লাভবান হয়েছেন কি-না সেটাও যাচাই করা হচ্ছে। ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, করোনা সনদ জালিয়াতির সঙ্গে ওভাল গ্রুপের সাত পরিচালকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করোনা সনদ জালিয়াতির সঙ্গে যাদেরই সম্পৃক্ততা আসবে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী কার্ডিয়াক সার্জন পরিচয় মিথ্যা : ডা. সাবরিনা দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী কার্ডিয়াক সার্জন বলে নিজেকে পরিচয় দিলেও তা সঠিক নয়। তদন্তে দেখা গেছে, ডা. সাবরিনা দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী কার্ডিয়াক সার্জন বলে সব জায়গায় পরিচয় দিতেন। ২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে এ-সংক্রান্ত বিশাল লেখাও ছাপা হয়। এ ছাড়া ওভাল গ্রুপের বিভিন্ন প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তাকে দেশের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে উল্লেখ করা হতো। তবে বিষয়টি সঠিক নয়। দেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন ডা. শিমু পাল, তার পরে ডা. তাহেরা মেহের। দেশে বর্তমানে আরও ১০-১২ জন নারী কার্ডিয়াক সার্জন আছেন। একমাত্র ও প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন পরিচয়ের মাধ্যমেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন ডা. সাবরিনা।
করোনা পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গত ২৩ জুন জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানটির ৬ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ব্যাপারে মামলা হওয়ার পর ২৪ জুন করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য জেকেজির অনুমতি বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পুলিশি তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে করোনা সনদ জালিয়াতিতে ডা. সাবরিনার নাম আসে। এরপর গত ১২ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে ১৩ জুলাই তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার তার স্বামী আরিফকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।