আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে সাহেদ
ইচ্ছেমতো করোনা পরীক্ষার সনদ দেওয়া নিয়ে আলোচনায় আসা ধুরন্ধর প্রতারক মোহাম্মদ সাহেদ এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কবজায় বলে খবর পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, গত সোমবার র্যাবের অভিযানে তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালের রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুর শাখা এবং রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় সিলগালা করার পরপরই তাকে হেফাজতে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ ও র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, সাহেদ তাদের নজরদারিতেই আছেন; কোনোভাবেই পালাতে পারবেন না তিনি। তবে সাহেদ আটক আছেন কি না, সে বিষয়ে গতকাল বুধবার রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত র্যাব-পুলিশের কোনো কর্মকর্তার পরিষ্কার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
করোনার ভুয়া সনদ দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে গত মঙ্গলবার রাতে সাহেদসহ রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছে র্যাব। এ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হলো। মঙ্গলবারের মামলায় র্যাবের অভিযানে আটক ৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল আদালতের মাধ্যমে তাদের ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের বিরুদ্ধে ৬ হাজার মানুষকে কভিড-১৯ টেস্ট না করেই ভুয়া সনদ দেওয়া, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে প্রভাব খাটানোর, এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) ব্যবসার, ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার, চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অপকর্মের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে নানা সুযোগ নেওয়া সাহেদকে তার নিজ জেলা সাতক্ষীরায় দলীয় কোনো কাজেও দেখতে পাননি নেতাকর্মীরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, সাহেদের বাবার দেওয়া নাম মো. শাহেদ করিম। সেই নামের পাশাপাশি আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছেন মোহাম্মদ সাহেদ নাম দিয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি পুরান ঢাকার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেন। সাহেদ নিজেকে কখনো পরিচয় দিতেন মেজর ইফতেখার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনো কর্নেল ইফতেখার আহম্মেদ চৌধুরী বা মেজর শাহেদ করিম নামে। ব্যবহার করতেন ‘দৈনিক নতুন কাগজ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের পরিচয়ও। তথ্য অধিদপ্তর থেকে ইস্যু করা প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডও আছে তার। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পরিচয় দিতেন। রিজেন্ট হাসপাতাল, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, রিজেন্ট আইটি, কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের বহুমুখী প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বিস্মিত তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তিনি চ্যানেল আইর তৃতীয় মাত্রাসহ বিভিন্ন টক শোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে ‘গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও বিশ্লেষণ’ দিতেন। নিজেকে জাহির করতেন ‘অতি আওয়ামী লীগ’ হিসেবে।
সাতক্ষীরা সদরের কামালনগরে জন্ম নেওয়া সাহেদ নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকায় চলে আসেন। মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে মিরপুরের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে এটুকুই। সাহেদ সাতক্ষীরা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া করিম (বর্তমানে মৃত) ব্যবসায়ী সিরাজুল করিমের ছেলে। দরিদ্র পরিবারের ছেলে সাহেদ প্রতারণা ও মানুষ ঠকিয়ে এখন শতকোটি টাকার মালিক। অভিযোগ রয়েছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী ও বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই সময় বহুল আলোচিত ‘হাওয়া ভবনে’ও তার অবাধ যাতায়াত ছিল। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে ২ বছর কারাভোগ করেন সাহেদ। ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫ নম্বর সড়কে একটি এমএলএম কোম্পানি খোলেন তিনি, যার নাম ছিল বিডিএস ক্লিক ওয়ান। মূলত এই এমএলএম কোম্পানির মাধ্যমেই তার উত্থান শুরু। এমএলএম কোম্পানি খুলে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তখন সাহেদ নিজেকে মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী নামে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয় দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় দুটি ও বরিশালে একটি মামলা রয়েছে। মামলার পর কয়েক বছর তিনি ভারতের বারাসাতে সপরিবারে আত্মগোপন করে থাকেন। পরে নানা কৌশলে মামলাগুলো থেকে জামিন নিয়ে দেশে ফিরে এসে নতুন কারবার শুরু করেন।
বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে সাহেদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে উত্তরাসহ বেশ কয়েকটি থানায় ৮ মামলা হয়েছে। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা ঋণ নেন সাহেদ। সেখানে দাখিল করা নথিপত্রে নিজেকে কর্নেল (অব.) ইফতেখার আহম্মেদ চৌধুরী পরিচয় দেন। এই ভুয়া পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র দাখিল করায় তার বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা চলছে।
সাহেদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে তোলা ছবি তার ফেইসবুকের কভার ফটো করেছেন, যা গতকালও ছিল। এ ছাড়া তার ফেইসবুকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতার এবং মন্ত্রী, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার অসংখ্য ছবি রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ছবি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধামকি দিতেন সাহেদ। সাহেদের উত্তরার রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ছিল একটি টর্চার সেল। সেখানে বন্দুকধারী বডিগার্ড রাখতেন তিনি। অফিসে লাঠিসোঁটা রেখে লোকজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাহেদ উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের ৩৮ নম্বর বাড়িতে ২০১০ সালে স্থাপন করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। মিরপুরের শাখাটি তারও আগের। যার কোনোটির বৈধ সনদ ছিল না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স ও যন্ত্রপাতি না থাকার পরও চুক্তিভিত্তিক দালালের মাধ্যমে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে এনে লাখ টাকা আদায় করতেন। উত্তরা পশ্চিম থানার পাশে রয়েছে তার রিজেন্ট কলেজ ও ইউনিভার্সিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। যদিও এগুলোর সব কটির বৈধ সনদ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখার মাধ্যমে হাজার হাজার সদস্যের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এর আগেও তিনি উত্তরার ৪, ৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে অফিস খুলে ভুয়া শিপিং ব্যবসা করেছেন। সেখানে বিনিয়োগের নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। কিছুদিন আগে তিনি একটি অস্ত্রের লাইসেন্সও নিয়েছেন।
২০০৯ সালে প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ ও র্যাব সাহেদকে গ্রেপ্তার করেছিল। ওই মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, খুলনার একটি টেক্সটাইল মিলের জন্য দুই টনের ১০টি ও দেড় টনের ১৫টি এসি সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছিল সাহেদ করিমের প্রতিষ্ঠান। জিনিসপত্র নিয়ে ১৯ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন রাইজিং শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি এবং রাইজিং রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম। অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় চেকটি পাস হয়নি। ওই ঘটনায় মামলা করেছিল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি।
রিজেন্ট হাসপাতালে যারা করোনা উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়েছেন তারাও এখন চরম আতঙ্ক এবং ভয়ের মধ্যে আছেন। প্রতারিত রোগীরা র্যাবের কাছে ধরনা দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছেন তাদের দেওয়া কভিড-১৯-এর সনদ আসল না নকল। গত দুদিনে অন্তত তিন হাজার ভুক্তভোগী র্যাব কর্মকর্তাদের ফোন করেছেন। র্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে ৬ হাজার রোগীর রিপোর্ট রয়েছে। সেগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
সাহেদ সম্পর্কে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাহেদ কিছুতেই দেশ ছেড়ে পালাতে পারবেন না। সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাকে ধরতে একাধিক টিম মাঠে আছে এবং তিনি আমাদের নজরদারিতে আছেন। সাহেদ এত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন যে চাইলেও পালাতে পারবেন না। সাধারণ মানুষই তাকে ধরে ফেলতে পারবে। তার পক্ষে বেশি দিন ‘আত্মগোপন’ করে থাকা সম্ভব নয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতারক সাহেদকে যেকোনো সময় আটক দেখানো হবে। র্যাবের পাশাপাশি পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তার বিষয়ে কাজ করছেন।’
আরেক কর্মকর্তা জানান, বছর তিন-চারেক আগে সাহেদ নিয়মিত পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষে ঘোরাঘুরি করতেন। ঘন ঘন টক শোতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনি নিজের প্রভাব বাড়িয়েছেন। নিজেকে উত্তরা মিডিয়া ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও পরিচয় দিতেন তিনি।
অভিযান পরিচালনাকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে বিনামূল্যে কভিড-১৯ চিকিৎসার চুক্তি স্বাক্ষরের নামে আসলে হঠকারিতা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বিল নিয়েছে। রিজেন্টের কম্পিউটার অপারেটর আমাদের বলেছেন, চেয়ারম্যান নিজে ব্যক্তিগতভাবে এসব করিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ২ মাসে আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকাগুলো কোথায় গেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাহেদ ও তার সহযোগীদের অর্থ পাচারের বিষয়টি তারা অনুসন্ধান করছেন। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলা করা হবে। এ ছাড়া তার অর্থ কোথায় কোথায় গেছে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে তার নানা অপকর্মের কথা জানতে পেরেছি। বিভিন্ন সময় তিনি প্রতারণার দায়ে আটক হয়েছিলেন, জেলও খেটেছেন। মিথ্যা ও প্রতারণাকে হাতিয়ার করেই তার উত্থান। তার অনেক বেনামি প্রতিষ্ঠানও আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি কোনো অনুমোদন নেননি। চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন সাহেদ। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান তিনি।
সবই জেনেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজীদ খুরশিদ রিয়াজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে গত ৭ জুন একটি চিঠি দিয়েছিলেন রিজেন্টের অপকর্ম নিয়ে। চিঠিতে বলা হয়, রিজেন্ট হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা করে আদায় করছে। অথচ সরকার বিনামূল্যে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করে দিচ্ছে। নিপসম থেকে পরীক্ষার ফলাফল জানানোর জন্য যে এসএমএস প্রত্যেক নমুনা প্রদানকারীকে পাঠানো হচ্ছে, তাতেও বিনামূল্যে এই সেবা দেওয়ার বার্তা থাকছে।
ওই চিঠির পরও অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা রিজেন্ট থেকে দিনে ৫০টি নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে জানতে নাসিমা সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের দাবি, শুরুতে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কভিড রোগীর চিকিৎসা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তাই তারা সরল বিশ্বাসে রিজেন্টকে দায়িত্ব দেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব একটি গণমাধ্যমকে বলেন, এমন একটি হাসপাতালকে চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় নিয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। ক্ষমতাবানরা এর পেছনে থাকতে পারেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস (বিআইএইচএস) সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। চিঠিও দিয়েছিল। টাকাপয়সাও চাওয়া হয়নি। তারপরও বিআইএইচএসকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। রশিদ-ই-মাহবুবের ধারণা, এমন পর্যায় থেকে এই সিদ্ধান্ত এসেছে, যা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের নেই।
র্যাবের মামলার আসামি যারা : রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (৪৮), ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজ (৪০), হাসপাতাল কর্মচারী তরিকুল ইসলাম (৩৩), স্টাফ আবদুর রশিদ খান (২৯), স্টাফ শিমুল পারভেজ (২৫), কর্মচারী দীপায়ন বসু (৩২), আইটি বিশেষজ্ঞ মাহবুব (৩৩), আইটি বিশেষজ্ঞ সৈকত (২৯), সাহেদের ব্যক্তিগত সহকারী ও আইটি বিশেষজ্ঞ পলাশ (২৮), প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান হাবীব (৪৫), এক্স-রে টেকনিশিয়ান আহসান হাবীব হাসান (৪৯), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাকিম আলী (২৫), রিসিপশনিস্ট কামরুল ইসলাম (৩৫), রিজেন্ট গ্রুপের প্রজেক্ট অ্যাডমিন রাকিবুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৯), রিজেন্ট গ্রুপের এইচআর অ্যাডমিন (রিজেন্ট করপোরেট অফিস) অমিত বণিক (৩৩), গাড়িচালক আবদুস সালাম (২৫), প্রধান কার্যালয়ের হিসাব শাখার নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রশীদ খান জুয়েল (২৮)। আসামিদের মধ্যে ৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার ৭ জন ৫ দিনের রিমান্ডে : গ্রেপ্তার দেখানো ৭ জনের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল বুধবার শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারা হলেন আহসান হাবীব, আহসান হাবীব হাসান, হাকিম আলী, রাকিবুল ইসলাম, অমিত বণিক, আবদুস সালাম ও আবদুর রশিদ খান জুয়েল। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা থানার পরিদর্শক আলমগীর গাজী।
রিজেন্টের মিরপুর শাখাও সিলগালা : রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের কার্যালয়ের পর মিরপুর শাখাটি সিলগালা করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম হাসপাতালটি সিলগালা করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালটির সনদের মেয়াদ নেই। টেস্ট না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিত তারা। এ জন্য এ শাখাটিও সিলগালা করা হয়েছে।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় সাতক্ষীরার মানুষ : দেশ রূপান্তরের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন জানিয়েছেন, সাহেদের ঘৃণীত অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন জেলার মানুষ। জেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ও পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফারহা দিবা খান সাথী বলেন, তিনি ৩৬ বছরের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জীবনে সাহেদকে সাতক্ষীরার কোনো দলীয় কর্মসূচিতে দেখেননি। এমনকি দলের ন্যূনতম প্রাথমিক সদস্যও নন। এই প্রতারক মূলত সরকারি দলের অপব্যবহারকারী। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের তল্পিবাহক, পরে আওয়ামী লীগ আমলে করেছে একই কাজ। আর প্রতারণা করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তবে এই অবৈধ সম্পদের জন্য সাহেদ যেভাবে করোনাকালে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, তার জন্য তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এই প্রতারক সাহেদ যা করেছে তার অপরাধসীমার চূড়ান্ত। এসব ধুরন্ধুর যা করে তা-ই করেছে। এরা বিভিন্ন সময় ঢাকায় থেকে জেলার পদপদবি বাগানোর চেষ্টা এমনকি দলের মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টার খবরও আমরা শুনেছি। তবে মানুষের জীবন নিয়ে সে যে অন্যায় করেছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই প্রতারক সাহেদের সাতক্ষীরায় জনসম্পৃক্ততা না থাকলেও পুলিশের কাছে বিভিন্ন সময় নিজেকে বিশাল কিছু দাবি করে ফোন করতেন। পুলিশের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতেন।