পাঁচ কেজি ইলিশের দাম ১৫০০ টাকা!
বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সদস্য মাহবুব সিকদারের ছত্রছায়ায় ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম মেঘনা নদীর অন্তত ১০টি পয়েন্টে মা ইলিশ শিকারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে ইলিশ ধরা থেকে বিক্রি সবই হচ্ছে মাহবুব সিকদারের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।
অবৈধভাবে ধরা সোয়া কেজি ওজনের এক হালি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ে ৩০০ টাকা। ইলিশ অভিযান শুরু হওয়ার আগে সোয়া কেজির একটি ইলিশই বিক্রি হয়েছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়।
জানা গেছে, হরিনাথপুর ইউনিয়ন সংলগ্ন মেঘনা নদীর প্রায় ৩ বর্গ কিলোমিটার নিয়ন্ত্রণ করছেন মাহবুব সিকদার। ওই ৩ বর্গ কিলোমিটারের অন্তত ১০টি পয়েন্টে কারেন্টজালসহ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে প্রতিদিন শত শত মণ ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইলিশ শিকার, বিক্রি ও থানা-পুলিশসহ মৎস্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। নেপথ্যে থেকে ওই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুবলীগ সদস্য মাহবুব সিকদার।
এর আগেও মাহবুব সিকদারের নেতৃত্বে এক যুবককে মল-মুত্র খাওয়ানো হয়েছিল। তাছাড়া নানান অভিযোগে ইউনিয়নের বর্তমান কমিটিতে তাকে রাখা হয়নি।
হরিনাথপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী ও জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাহবুব সিকদারের নেতৃত্বে এলাকায় শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেটের বেশিরভাগ সদস্য তার আত্মীয়-স্বজন। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যদের প্ররোচনায় শতাধিক অসাধু ও মৌসুমি জেলে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও উপজেলার বদরপুর,গঙ্গাপুর, টুমচর, চরআবুপুর, আসলী আবুপুর, চরছঁওগাও, আলীগঞ্জ, নাচোকাঠি সংলগ্ন মেঘনা নদীতে নির্বিচারে মা ইলিশ শিকার করছেন। অবৈধভাবে ধরা এসব ইলিশ কোথাও প্রকাশ্যে আবার কোথাও গোপনে বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, বাবুল সিকদার, বাদল সিকদার, অপু সিকদার, জিয়াবুল সিকদার, দেলোয়ার সরদার, কালু সরদার, রিপন সরদার, আলম সরদার, রাজ্জাক সরদারসহ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ওই সিন্ডিকেটের সদস্য।
সিন্ডিকেটের সদস্যরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করেন। একটি দল ইলিশ শিকারের ট্রলার থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে তুলে মাহবুব সিকদারকে দেয়। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রলারের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০টি। আরেকটি দল ইলিশ কেনা-বেচার কাজে তদারকি করে।
অপর দলটি থানা-পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার কাজ করে। তাছাড়া এ দলটি আগেভাগেই অভিযানের খবর পৌঁছে দেয় নদীতে থাকা ট্রলারগুলোতে।
স্থানীয়রা জানান, হরিনাথপুরের গুচ্ছগ্রাম, বদরপুরের কৃষ্ণপুরের হারি, টুমচরের শৌলাগড়া, চরআবুপুরের ফেরিঘাট, আসলী আবুপুরের পিচ ঢালাই রাস্তার মাথায়, চরছঁয়গাও, ক্রোপচরের মাথায়, গঙ্গাপুর এলাকাগুলোতে স্বল্প দামে মিলছে ইলিশ। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা ও বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এলাকাগুলোতে ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, মাহবুব সিকদার নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের লোক বলে এলাকায় পরিচয় দেন। তার ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। পুলিশের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা রয়েছে। নদীতে ইলিশ নিধন চলাকালে বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে জানানোর পরও তারা রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেন। অনেক সময় লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়।
বদরপুর এলাকার কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাছ শিকার করে যা আয় হয়, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। আগে সর্বোচ্চ ১৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২২ দিন। কিন্তু খাদ্য-সহায়তা বাড়ানো হয়নি। ধার-দেনা করে ট্রলার ও জাল কিনতে হয়েছে। যারা ধার দিয়েছেন তারা এলাকায় প্রভাবশালী। এলাকায় অন্য কোনো কাজ নেই। ধার-দেনার চাপ ও সংসার চালাতে ইলিশ শিকার করতে হচ্ছে।
তারা জানান, বর্তমানে নদীতে জালে ইলিশ মাছ বেশি উঠছে। আগে নদীতে জাল পেতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষোর পর দু’চারটা ইলিশ ধরা পড়ত। কিন্তু এ সময় (নিষেধাজ্ঞা চলাকালে) নদীর নির্দিষ্ট পয়েন্টে ঘণ্টা খানেক জাল পেতে রাখলেই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। ইলিশের আকারও বড়।
তারা আরও বলেন, প্রশাসনের অভিযানের খবর আমরা আগেই পেয়ে যাই। তাদের ট্রলার আসার খবর পেয়ে আমরা নিরাপদে সরে যাই। তাছাড়া তাদের ট্রলারের চেয়ে আমাদের বেশিরভাগ ট্রলারের ইঞ্জিন শক্তিশালী। অনেক দ্রুত চলে। দূর থেকে তারা আমাদের মাছ ধরতে দেখলেও ধরে ফেলার আগেই আমরা পালাতে সক্ষম হই।
তারা জানান, ইলিশ বিক্রিতেও তেমন ঝামেলা নেই। সাধারণ ক্রেতারা নদীর পাড়ে বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নেয় মাছ কেনার জন্য। তাছাড়া গ্রামগঞ্জে এখন বিদ্যুৎ আছে। অনেকের বাড়িতেই ফ্রিজ আছে। কয়েকজনের বাড়িতে দু’তিনটে করে ডিপ ফ্রিজ আছে। তারা আমাদের কাছ থেকে খুব কম দামে ইলিশ কিনে ফ্রিজ করে রেখে দেন। নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে তারা ওই মজুদ ইলিশ বাজারে বেশি দামে বিক্রি করবেন।
তাছাড়া কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা স্বল্প দামে ইলিশ কিনে দুর্গম চরে গভীর খাদ করে সেখানে বরফ দিয়ে হোগলার মধ্যে রাখেন। নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে ওই ইলিশ মোকামে বিক্রি করা হবে।
জেলেরা বলেন, অভিযানের খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য লোক আছে। তারা প্রতিদিন প্রতিটি ট্রলার থেকে ৫০০ টাকা করে তোলেন। তারা বলেছেন ওই টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দিয়ে থানা-পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা হয়। তাদের টাকা না দিলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে উদ্যোগটি সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছে তা হলো অভয়াশ্রম গড়ে তোলা। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের ৬টি অভয়াশ্রম বড় ভূমিকা রেখেছে। হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট, নাচোকাঠি পয়েন্ট ও ধর্মগঞ্জ পয়েন্ট ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের আওতায় রয়েছে।
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগরের নোনা পানি ছেড়ে নদীর মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে ছুটে আসে। এ সময় অভয়াশ্রমগুলোতে মা ইলিশের বিচরণ ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। ডিমওয়ালা মা ইলিশের নির্বিঘ্ন চলাচল এবং প্রজননের জন্য অভয়াশ্রমগুলোতে ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের জন্য সবধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
শুধু তাই নয়, এ সময় ইলিশ পরিববহন, বিক্রয় ও মজুদ নিষিদ্ধ থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো জেলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নামলে তার বিরুদ্ধে মৎস্য সংরক্ষণ আইনে মামলাসহ জেল জরিমানারও বিধান রয়েছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাহবুব সিকদার বলেন, হরিনাথপুরের মেঘনা নদীর বেশকয়েকটি পয়েন্টে দুই থেকে আড়াই শতাধিক মানুষ মাছ ধরছেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে নদীর ধারে কাছেও যাইনি আমি। এরপরও একটি মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনকে ম্যানেজসহ আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা তা সবই ভিত্তিহীন।
হিজলা নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ বেল্লাল হোসেন জানান, কিছু কিছু স্থানে জেলেরা কৌশলে ইলিশ শিকার করছেন। নদীতে জাল ফেলে তারা চলে যান। পরে সুযোগমতো জাল তুলেন। তবে মা ইলিশ রক্ষায় মেঘনাসহ শাখা নদীতে নিয়মিত নৌপুলিশ সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নদীবেষ্টিত হিজলা উপজেলায় অনেক দূর্গম এলাকা রয়েছে। মাছ শিকারের খবর পেয়ে সেখানে ট্রলারে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। দূর থেকে তাদের দেখা গেলেও কাছে যাওয়ার আগেই তারা পালিয়ে যান। শক্তিশালী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ব্যবহার করায় তাদের গতির সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয়েছে নৌপুলিশ সদস্যদেরও।
হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, আমি হিজলায় এসেছি মাত্র ১৭ দিন। এখনও সব এলাকা চেনাজানা হয়নি। মা ইলিশ ধরা বন্ধে আমরা নিয়মিত নদীতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। তবে জনবল ও জলযান সংকটে উপজেলার বিশাল জলসীমায় নজরদারি বা অভিযান চালাতে বেগ পেতে হতে হচ্ছে। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হিজলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বকুল চন্দ্র কবিরাজ জানান, মা ইলিশ রক্ষায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে আইন অমান্যকারীদের জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নৌ-পুলিশের বরিশাল অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন জানান, হিজলা উপজেলার কয়েকটি স্থানে মা ইলিশ শিকারের অভিযোগ পেয়ে সেখানে নৌপুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। মেঘনাসহ শাখা নদীতে সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে জিরো টলারেন্স দেখানো হচ্ছে। ইলিশ শিকারি অসাধু জেলে এবং মদদ দাতাদের তালিকা করা হচ্ছে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।