১০ মাস ধরে পরিচালক ছাড়াই চলছে বেনাপোল বন্দর
একটানা ১০ মাস অতিবাহিত হতে চললেও দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে পরিচালক পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে চরম অব্যবস্থাপনায় চলছে বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম। একজন উপপরিচালক বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। যেকোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ে থাকতে হয় ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে দিকে। ওখান থেকে দিক-নির্দেশনার পরে কাজ হয় এ বন্দরে।
বেনাপোল বন্দরকে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় আনার পর ১৯ বছরে ১৩ জন পরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন। আর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেছেন দুজন উপপরিচালক চারবার। উপসচিব পদমর্যাদায় এখানে নিয়োগ পাওয়ার পর ২/৪ মাস কাজ করার পর বদলির তোড়জোড় করতে থাকেন কর্মকর্তারা। এর ফলে কেউ আসতে চায় না এ বন্দরে; তেমনি কেউ আসলেও ৪ মাস, ৬ মাস বা এক-দেড় বছর থাকার পর তদবির করে চলে যান অন্যত্র।
জানা যায়, কলকাতা থেকে বেনাপোলের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে দেশে স্থলপথে যে পণ্য আমদানি হয় তার ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায়ও প্রথম সারিতে বেনাপোল বন্দর। দেশের সিংহভাগ গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজসহ বিভিন্ন শিল্পকলকারখানার কাঁচামাল আমদানি হয় এ বন্দর দিয়ে। রাজস্ব আয়ের দিক থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের পরেই বেনাপোল বন্দরের অবস্থান। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে, যা থেকে সরকারের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রপ্তানি হয়েছিল চার লাখ এক হাজার ১৭৭ মেট্রিকটন পণ্য। করোনার মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার ৮২৯ মেট্রিক টন পণ্য।
বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে. ১৯৭৮ সালে অবলুপ্ত ওয়ার হাউজিং করপোরেশন (বিডাব্লিউসি) বেনাপোল বন্দরের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালের ৬ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেনাপোল বন্দরকে শুল্ক আইন-১৯৬৯ তে শুল্ক স্টেশন ঘোষণা করেন। প্রজ্ঞাপন নম্বর ৪৯৩/ডি/কাস/৭৯। ১৯৭৯ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশ পাট মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেন বন্দরের। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে ১০.২৩ একর জমির ওপর অবস্থিত ১১টি গুদাম ও ২টি উন্মুক্ত শেড গ্রহণ করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করে। সর্বশেষ ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।
মোংলা বন্দরের দায়িত্বে থাকা মাহাবুব উল্লাহকে বন্দর পরিচালক পদে সংযুক্ত করা হয় ২০০১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। এর পর থেকে পরিচালক পদে পর্যায়ক্রমে এখানে দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ নৌ-পরিবহনের সাইফুল হক খান, উপসচিব শ্যাম কিশোর রায়, উপপরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম, উপসচিব এম গোলাম মোস্তফা, উপসচিব এম এম তারিকুল ইসলাম, উপসচিব এম গোলাম মোস্তফা, উপসচিব আবুল কালাম আজাদ, উপসচিব আব্দুল আউয়াল হাওলাদার, উপসচিব তোফাজ্জেল হোসেন, উপসচিব ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন, উপপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল, উপসচিব নিতাই চন্দ্র সেন, উপপরিচালক আমিনুল ইসলাম, উপসচিব আব্দুর রউফ, উপপরিচালক আমিনুল ইসলাম, উপসচিব প্রদোষ কান্তি দাস। তিনি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে চলে যান বদলি হয়ে। এরপর থেকে এখনো কোনো পরিচালক নিয়োগ দেয়নি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, প্রতিবছর এই বন্দর থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে থাকে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোর চিত্র বেহাল। এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব ও অর্থনৈতিক ক্ষতিতে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এপথে বাণিজ্যের গুরুত্ব বাড়ায় এর মধ্যে বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে অত্যাধুনিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে। সেখানে পুরো বন্দর এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, রয়েছে উন্নত মানের সড়ক ব্যবস্থা, শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত এসি ওয়ার হাউজ, চোরাচালান প্রতিরোধে স্কানিং ব্যবস্থাসহ আরো অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। কিন্তু বেনাপোল বন্দরে ওই একই সুবিধা থাকার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত একটিও গড়ে ওঠেনি। এখানে যে সব কর্মকর্তারা আসেন তারা আঞ্চলিকতার টানে এখানে আসতে চান না। বেনাপোল বন্দরের রাজস্ব আয়ে অন্য বন্দর উন্নয়ন হলেও এখানে উন্নয়ন করা যতটুকু প্রয়োজন তা-ও করা হচ্ছে না। তাছাড়াও এখানে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের হাতে দাপ্তরিক ক্ষমতাও কম। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়রম্য্যানের নির্দেশ ছাড়া তারা কিছুই করতে পারেন না।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সদস্য এস এম হুমায়ুন কবীর কবু বলেন, বেনাপোল বন্দর থেকে সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আয় করে থাকে তার একটা অংশ যদি এই বন্দরের উন্নয়নে ব্যয় করা হয় তাহলে বন্দরের চেহারা পাল্টে যাবে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে বাড়বে আমদানি-রপ্তানি। বৃদ্ধি পাবে রাজস্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য আমদানিকৃত কোটি কোটি টাকার মালামাল খোলা আকাশের নিচে রাখা হচ্ছে। এখানে নেই কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গুদাম। যার ফলে ওষুধের কাঁচামাল ভারতীয় গাড়ি থেকে বাংলাদেশি গাড়িতে ওঠানোর ফলে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। স্থান সংকটের কারণে ভারত থেকে পণ্য এনে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ট্রাকচালকদের। তারপরও রহস্যজনক কারণে অবকাঠামো বাড়াচ্ছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার জানান, একজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা এখানে নিয়োগ দিলে তারা এখানে এসে কয়েকদিন পর বদলি হয়ে চলে যান। আবার অনেকে এখানে আসতেও চান না। বর্তমান বন্দরের উপপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের কাজ করছেন। আপাতত এখানে কোনো সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমরাই সেটার দ্রুত সমাধান করে দিচ্ছি।