আমিরাত থেকে প্রবাসী আয়ে নতুন ‘চমক’
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৬.৫৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের এই উল্লম্ফনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) অবস্থানকারী প্রবাসীরা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও আমিরাত থেকে রেমিট্যান্সে ‘চমক’ অব্যাহত রয়েছে; সেইসঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রবাসী আয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার রেমিট্যান্স প্রবাহের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আরব আমিরাত থেকে ১০৩ কোটি ২২ লাখ (১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমিরাত থেকে ৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল।
এই তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯২ কোটি ৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৫১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। হিসাব বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ধরে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষস্থানে ছিল যে দেশ, সেই সৌদি আরব থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৮৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৮১ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার ডলার; বেড়েছে ৫ শতাংশ।
তবে এই তিন মাসে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ খানিকটা কমেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে ৫৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৫৮ কোটি ৮৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। কমেছে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের মতোই এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে আরিব আমিরাত থেকে। দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে যথাক্রমে সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্য।
হিসাব করে দেখা যায়, এই তিন মাসের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ১৬ শতাংশ এসেছে আমিরাত থেকে। ১৪ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আর যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা শুরু হয় বাংলাদেশে। ওই বছরে মাত্র ১ কোটি ১৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেই রেমিট্যান্স দুই হাজার গুণের বেশি বেড়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
গত অর্থবছরের আগে পঞ্চাশ বছরে প্রতিবারই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৌদিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।
শুধু তাই নয়, রেমিট্যান্স আহরণের তালিকায় সৌদি আরব নেমে যায় চতুর্থ স্থানে। দ্বিতীয় স্থান বহাল রেখেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র; তৃতীয় ছিল যুক্তরাজ্য।
গত অর্থবছরে সৌদি আরবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রেমিট্যান্স আসে আমিরাত থেকে। ওই অর্থবছরে সৌদি থেকে ২৭৪ কোটি ১৫ লাখ (২.৭৪ বিলিয়ন) ডলার আসে। আমিরাত থেকে আসে ৪৬০ কোটি (৪.৬ বিলিয়ন) ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ (২.৯৬ বিলিয়ন) ডলার আসে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ কম, ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ (৩.০৩ বিলিয়ন)। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে যথাক্রমে ৩৫২ কোটি ২০ লাখ (৩.৫২ বিলিয়ন) ও ২০৮ কোটি ৪ লাখ ডলার।
তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) সৌদি থেকে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। আমিরাত থেকে এসেছিল অর্ধেকেরও কম, ২০৭ কোটি ১৮ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৩৪৩ কোটি ৮৪ লাখ (৩.৪৩ বিলিয়ন) ও ২০৩ কোটি ৯২ (২.৩ বিলিয়ন) লাখ ডলার।
ওই দুই অর্থবছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের উৎস ছিল আরব আমিরাত। দ্বিতীয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের পাঁচ ভাগের এক ভাগই এসেছিল আরব আমিরাত থেকে। সৌদি আরবের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল আরব আমিরাত থেকে; যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি এসেছিল ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ৬৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি এসেছিল যুক্তরাজ্যের চেয়ে।
গত অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে রেমিট্যান্স কম এসেছিল ২৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। তবে আমিরাত থেকে বেড়েছিল ৫১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমেছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে যুক্তরাজ্য থেকে বেড়েছিল ৩৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।
আরব আমিরাত মূলত পাথুরে মরুভূমি, উপকূলীয় সমভূমি এবং পাহাড়ের মিশ্র পরিবেশে গঠিত দেশ। তবে দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল মরুভূমি। তেলশিল্পের কারণে এখানকার অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী এবং জীবনযাত্রার মানের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি।
ফেডারেশনের অর্থনীতি প্রধানত আবুধাবির উৎপাদিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে দুবাইয়ের অর্থনীতি ব্যবসা ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি আরব আমিরাত তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশটি পর্যটনশিল্প এবং পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে।
আরব আমিরাতে আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ও গগনচুম্বী ভবন। বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ অট্টালিকা ‘বুর্জ খলিফা’ দুবাই শহরেই। প্রশস্ত রাস্তা ও সুপার হাইওয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে আমিরাতের। পারস্য উপসাগরের কূলে ৫ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ।
পামগাছের মতো দেখতে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ‘পাম জুমেইরা’। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
এছাড়া বড় বড় অবকাঠামো তৈরি গোটা দেশজুড়ে। সে সব অবকাঠামোয় বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করছেন। এ সব কারণে চাঙা অর্থনীতির এই দেশটিতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ভালো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। সেখান থেকে বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।